মোবাইল ফোনের দুনিয়ায়


সুবল সরদার
আমাদের এই সুন্দর নীল গ্ৰহের পৃথিবীটা কীভাবে হারিয়ে যাচ্ছে মোবাইল ফোনের মধ্যে। আমাদের মিষ্টি শৈশবের স্মৃতির পৃথিবী আর নেই। নদী গান গায় না। পাখির ডাকে ভোর আসে না। ঝর্ণা বয়ে না নূপুরে সুর তুলে। ফুলের সৌরভে অলির গুঞ্জন কোথায়? সব কেমন ছন্নছাড়া, এলোমেলো ,বেসুরো হয়ে উঠেছে। এই সুন্দর পৃথিবী মোবাইল ফোনের পৃথিবী হয়ে উঠেছে। শিশু থেকে কৈশোর, কৈশোর থেকে যৌবন বন্দী হয়ে যায় মুঠোর ফোনের মধ্যে। বার্ধক্যও মোবাইল ফোনের অসুখ থেকে মুক্ত হতে পারে না। সে একা হয়ে যায়। পৃথিবীর রূপ- রস -গন্ধ তার ভালো লাগে না। সে মাঠে খেলতে ভুলে যায় । পুকুরে সাঁতার কাটতে পারে না। গাছে উঠে আম পাড়তে পারে না। মোবাইল ফোন আমাদের জীবনকে পঙ্গু করে দিয়েছে। সে আমাদের রূপসী পৃথিবীকে চুরি নিয়ে, দিয়ে গেছে একটা স্বার্থপর, হিংসা, দ্বন্দ্বের পৃথিবী । এভাবে আমাদের প্রেমের পৃথিবী, কবিতার পৃথিবীকে অপ্রেম, অ -কবিতার পৃথিবী উপহার দেয়। মোবাইল ফোন ব্যবহার থেকে অপব্যবহার বেশি হয় । এ বিজ্ঞানের আশীর্বাদ নয়, অভিশাপ।‌ তাই কবি জীবনানন্দ দাশ বলেছেন- ‘তবুও কোথাও তার প্রাণ নেই —
জ্ঞান নেই আজ এই পৃথিবীতে: জ্ঞানের বিহনে প্রেম নেই’। মোবাইল ফোন একটা সংকীর্ণ, হিংসা, মানবিকতাহীন,স্বার্থপর পৃথিবী তৈরি করেছে। মোবাইল ফোনে এখন আমরা মরি, বাঁচি। মোবাইল ফোন এখন আমাদের জগৎ, আমাদের ধান জ্ঞান,প্রাণ।‌
প্রেমের চিঠি নেই, গানের স্বরলিপি নেই, রামধনুর রঙ নেই। সেই জগৎ থেকে ঢেড় দূরে আমরা শুধু ধূসর মোবাইল ফোনের পৃথিবীতে বাস করি । সেদিন কে ভেবেছিল মোবাইল ফোন ফ্রাঙ্কেনস্টাইনের মতো আমাদেরকে গিলতে আসবে। আমাদের এই সুন্দর গ্ৰহ কী হার মানবে মোবাইল ফোনের কাছে না সূর্য গ্ৰহণের মতো রাহু মুক্তি হবে একদিন? বিশ্ব কবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর বলেছেন -লহ এ শহর , ফিরিয়ে দাও সে অরণ্য । তেমনি করে আমরা বলতে পারি – ফিরিয়ে দাও আমাদের সেই প্রেমের পৃথিবী, নিয়ে যাও এই বিষাক্ত মোবাইল ফোনের পৃথিবী ।‌ আমাদের সেই হাসি -কান্নার পৃথিবী আর নেই । এখন শুধু যন্ত্রণা, হতাশা ,অবসাদের পৃথিবী। ফাগুনের হাওয়ায় হাওয়ার গান নেই। বসন্তের সমীরণ নেই। শরতের মেঘ মুক্ত আকাশ নেই। হেমন্তের শিশির ভেজা ঘাস নেই। শ্রাবণ ধারার ছন্দ নেই। গোধূলির সূর্যাস্তের রঞ্জিত ছটা নেই। রাতে গা ছমছম ভূতের গল্প নেই। শিহরণ জাগা রূপ কথার গল্প নেই। রাতের তারকা খচিত আকাশ নেই। রবিবারের আড্ডা নেই। নদীর বালুকা বেলা নেই। নদীর ঢেউ বিরহে চির বিরহিনী হয়ে বয়ে যায় নিঃশব্দে। এভাবে মোবাইল ফোন আমাদের নান্দনিক জগৎ থেকে নারকীয় জগতে নিয়ে যায় যেখানে আমরা নিঃস্ব,রিক্ত, একাকিত্ব হয়ে যাই । আমরা কেমন যান্ত্রিক হয়ে উঠি।
পড়াশুনা লাটে ওঠে যখন মোবাইল ফোন কিশোর -কিশোরীদের হাতে আসে। তারা পড়াশোনাতে নেই, শুধু মোবাইল গেমসে/ পাবজী খেলায় আছে। মোবাইল ফোনের গেমসে তারা আত্মহারা হয়ে ওঠে । তারা ল্যাবে নেই, শুধু ট্যাবে আছে। মোবাইল ফোন কানে দিয়ে রাস্তা পারাপারের সময় কত তাজা প্রাণ অকালে ঝরে যায়। এভাবে মোবাইল ফোনে তাদের জগৎ খোঁজতে মৃত্যুর ফাঁদে পা দেয় । কেউ কেউ মোবাইল ফোনের জন্যে আত্নহত্যা করে। অঙ্কুরে বিনষ্ট করার মতো মোবাইল ফোন এইভাবে কিশোর মনকে বিনষ্ট করে। চোখের সমানে থেকে রূপসী পৃথিবী কখন হারিয়ে যায় মোবাইল ফোনের দুনিয়ায় ।
যদি একটা মোবাইলহীন পৃথিবী থাকতো যেখানে অরণ্য, পাহাড়, নদী, ঝর্ণা খেলা করে ! যদি একটা মোবাইলহীন পৃথিবী থাকতো যেখানে প্রভাত হয়, সন্ধ্যা নামে ; যেখানে প্রাণ আছে,গান আছে, সুরে আছে; যেখানে হৃদয় নেচে ওঠে ছন্দে!

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *