টুকরো স্মৃতি নয়তো টুকরো

সুবল সরদার

ডায়মন্ড হারবার ফকির চাঁদ কলেজের ইংরেজির অধ্যাপক ছিলেন জয়ন্ত রায় । ক্লাসে স‍্যার প্রতিটা শব্দ ধীরে ধীরে পরিস্কার উচ্চারণ করতে করতে এক একটা করে বাক্য শেষ করতেন । এমনভাবে তিনি বলতেন যেন ডাক্তারবাবু রোগীর হাতে ইনজেকশনের সূচ ফোটাচ্ছেন । তাঁর পড়ানো ছাত্র ছাত্রীদের বুঝতে অসুবিধা হবার কথা নয় । আমরা তাঁকে পেয়েছিলাম ইলেভেন থেকে ইংরাজি অনার্স ক্লাসে । সময় ‘৮৬ ‘৮৭ থেকে হবে ।
তিনি আমাকে খুব স্নেহ করতেন । তখন বি এ ফার্স্ট ইয়ার হবে একদিন ইংরেজির ক্লাসে তিনি আমাদেরকে শেখাচ্ছিলেন কেমন করে লেটার লিখতে হয়। ব্ল‍্যাক বোর্ডে লেটার লিখলেন। তারপর সাবস্ক্রিপশন , শেষে সুপারস্ক্রিপশন মানে প্রাপকের ঠিকানায় সঠিক পিন নম্বর
সহ আমার ঠিকানা লিখলেন । সঠিক পিন নম্বর সহ আমার ঠিকানা ! সেদিন ক্লাসে আমি বিম্ময়ে হতবাক হয়েছিলাম । স‍্যার আমার দিকে একবার তাকিয়ে মুচকি হেসেছিলেন । সেকথা কী কখনও ভোলা যায় ! স‍্যারকে এখন খুব মিস করি । স‍্যারকে আমার বিনম্র শ্রদ্ধা ,প্রনাম নিবেদন করি ।

‌আমাদের কলেজের নবীন বরণ অনুষ্ঠানে স‍্যারের সঙ্গে আমার প্রথম দেখা হয়েছিল । তখন আমরা কলেজে সদ‍্য নতুন । কলেজের জি এস, অন‍্যান‍্য শিক্ষক সহ ছাত্র ছাত্রী মন্ডলী উপস্থিত ছিলেন ‌। তিনি ওই অনুষ্ঠান পরিচালনা করছিলেন। উদ্বোধন সঙ্গীত গেয়েছিল রুবি ,রবীন্দ্র সঙ্গীত ‘আগুনের পরশমণি ‘। সেও আমাদের মতো নতুন ইলেভেন আর্টসে ভর্তি হয়েছিল । আমাদের নতুনদের মধ্যে থেকে আমি বক্তব্য রেখেছিলাম । স‍্যার আমাকে সংক্ষেপে বলতে বলেছিলেন । মনে আছে প্রথম দিনের বিচিত্র ,সুন্দর অভিজ্ঞতা তুলে ধরার চেষ্টা করেছিলাম । বাঁধাধরা গন্ডি থেকে মুক্ত হয়ে মুক্ত কন্ঠে যুক্তির জাল বুনতে চাইছিলাম । জড়তা, আড়ষ্টতাও একটু ছিল । আ্যড্রেসিং এর পর বক্তব‍্য শুরু করেছিলাম এ রেড লেটার ডে টু আস শব্দগুলো দিয়ে । সত্যি দিনটা সোনালী বটে ,কখনও ভুলিনি ‌।
একজন সিনিয়র দাদার কথা খুব মনে পড়ে । তিনি আমাকে খুব উৎসাহ দিতেন । ওই অনুষ্ঠানে সেদিনও দিয়েছিলেন । আজও অপরেশদা ফোনের ও প্রান্ত থেকে আমাকে উৎসাহ দিয়ে যান যখন পত্রিকায় আমার লেখা প্রকাশিত হয়‌। তখন আমাদের কলেজের প্রিন্সিপাল ছিলেন হরিরাখাল বিশ্বাস । ভাইস প্রিন্সিপাল ছিলেন শিবপ্রসাদ হালদার ‌। তিনি আমাদেরকে বাংলা সাহিত‍্যর ইতিহাস পড়াতেন । বাংলা সাহিত্য ইতিহাসের একজন প্রথিতযশা লেখক ও ছিলেন ।

মনে করলে এক নিঃশ্বাসে বন্ধুদের কত নাম চলে আসে । রেশমী সেক্সী খাদিজা গালকাটি কী সব নাম ! আকাশভরা তারাদের নামের মতো তাদেরকে আমরা কত রোমান্সভরা নাম দিয়েছিলাম ফানি অর্থে ! কী আনন্দ ! তখন মুক্ত বিহঙ্গের মতো প্রথম ডানা মেলেছি বলে কথা । কৈশোরের স্বপ্ন দুচোখ ভরে । এখন বলতে পারবো না তারা কারা ছিল । সেই নামগুলি এখন কেবল ছায়ার মতো অস্পষ্ট । সুলেখা ,কৃষ্ণা, মানসী, সুমনা, দীপ্তি, দীপু ,মহেশ, শ‍্যামল ,সিরাজ, মনীষা, মৌসুমী ,রমা ,শিলা, বনশ্রী , সালেহা কত নাম স্মৃতির ভান্ডারে জমে আছে । একবার কলেজের বার্ষিক পত্রিকা ‘সবুজের স্বপ্নে’ আমার কবিতা ‘ব‍্যর্থ প্রেম ‘ ছাপা হলো না ‌। ব‍্যর্থ কিশোর কবির অসম্পূর্ণ স্বপ্ন নির্ঝরের স্বপ্ন ভঙ্গের মতো মনে ভীষন পীড়া দেয় । সেদিন বাস্তব জগতে হেঁটে কল্পনায় নিজেকে রুপালি পর্দার হিরো ভাবতে বেশ লেগেছিল ! সেদিনের সেই আনন্দের মুহূর্তগুলি আজও আমাকে সমানভাবে আনন্দ দেয় । সেই সোনালী মুহুর্তগুলি এখন কেমন সোনার খাঁচায় বন্দী !
সত্যি দিন ছিল আমাদের । এখনও তাদের জন‍্যে অপেক্ষা করি । তাদের জন‍্যে আছে আমার একরাশ ভালোবাসা আর শ্রদ্ধা ।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *