বাঘের আক্রমণে আক্রান্ত হয়ে ফিরে আসার কাহিনী

কলকাতা, ৫ই সেপ্টেম্বর ২০২৪: কিছু মানুষ বেঁচে থাকেন তাদের কথা বলার জন্য, বাকিরা ম্যানগ্রোভের জঙ্গলে বাঘের শিকার হয়ে যান। এই ভাবে মানুষ বনাম পশুর এই লড়াইয়ে, যা মোটেও সুখপ্রদ অভিজ্ঞতা নয় সুন্দরবনের মানুষদের, অনুপ্রেরণা মূলক হয়ে দাঁড়ায় সকলের কাছে, যেখানে মানুষ মনের জোরে প্রতিকূলতা জয় করে। চুয়ান্ন বছর বয়সী গৌর মণ্ডলকে গত ১৭ই আগষ্ট ২০২৪ দিনে একটি বাঘ আক্রমণ করে। তার ডান দিকের ঘাড় বাঘের কামড়ে ভয়ংকর ভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়। কামড়ের দাগ এবং আঁচড়ের দাগ সহ একাধিক চোট তো ছিলই, এছাড়া মাথার খুলির পিছনেও রয়েছে ভয়ংকর চোট। প্রত্যাঘাত করে গৌর মন্ডল বাঘের সামনে রুখে দাঁড়ান, যার ফলে আরো আঘাত এড়ানো সম্ভব হয়।

এই ভয়ানক আক্রমণের পর গৌর মণ্ডলকে দ্রুত একটি স্থানীয় হাসপাতালে ভর্তি করা হয়, যেখানে তার আঘাত গুলোর চিকিৎসা করা হয়। এরপর কলকাতায় তাকে ট্রান্সফার করা হয় পরবর্তী চিকিৎসা করার জন্য। পরিস্থিতির গুরুত্ব বিচার করে তাকে দ্রুত নিয়ে ভর্তি করা হয় মণিপাল হসপিটাল, ঢাকুরিয়াতে।সঙ্গে সঙ্গেই একটি বিশেষ টিম, যেখানে ছিলেন বিশেষজ্ঞ ডাক্তাররা, তারা দ্রুত চিকিৎসা পরিষেবায় নিয়োজিত হয়ে পড়েন। ইমার্জেন্সী টিম প্রস্তুত ছিল এবং দ্রুত ক্রিটিক্যাল সার্জারি করেন পরিস্থিতি সামাল দেওয়ার জন্য।

হসপিটালে আসার সাথে সাথে গৌর মন্ডলের সম্পূর্ণ ডায়াগনস্টিক পরীক্ষা নিরীক্ষা হয়, যার মধ্যে ছিল একাধিক সিটি স্ক্যান। সিটি স্ক্যান রিপোর্টে দেখা যায় যে ট্রমার মধ্যে, ফ্র্যাকচার, যা সাধারণত হয়ে থাকে যখন কোন হাড় তিন বা বেশি ভাগে ভেঙে যায়। মাথার খুলির পিছনে, অক্সিপিটাল কন্ডাইলে, সিলিন্দ্রিকাল হাড় যা খুলির সামনে ও পিছনে, এছাড়া স্টেইলয়েদ প্রোসেস, যা কানের দিকে ছিল।

বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ জায়গায় ফ্র্যাকচার হওয়ার কারণে প্রয়োজন হয়ে পরে দেখার যে কোন ক্ষতি হয়েছে কিনা, যা পুরোদস্তুর পক্ষাঘাতগ্রস্ত হয়ে যাওয়া থেকে অন্যান্য নিউরোলজিক্যাল সমস্যা, সবগুলো সম্ভাবনা ছিল। সিটি স্ক্যান রিপোর্টে আরো ধরা পড়ে যে ডান দিকের চিক বোনের কাছে একটি ফ্র্যাকচার, যা অস্ত্রোপচার করা জরুরি হয়ে পড়েছিল, অন্যথা মুখের আকৃতি এবং কার্যের ক্ষেত্রে বিপদজনক হতে পারত।

গৌর মন্ডলের একটি জটিল অস্ত্রোপচার সম্পন্ন হয়, যেখানে পিছনের সারভিক্যাল ডিকম্প্রেশন যুক্ত, যা এর আগে স্থানীয় ভেন এর উপর অতিরিক্ত চাপ এবং শিরদাঁড়া কম্প্রেসড করে দিয়েছিল। এই অস্ত্রোপচারের আরো কারণ ছিল ১৭টি হাড়ের ফ্র্যাগমেন্ট এবং বোন ডাস্ট, যা এই অস্ত্রোপচারের মাধ্যমে বাদ দেওয়া হয়। ডঃ নিরুপ দত্ত, কনসালটেন্ট নিউরোসার্জন, মণিপাল হসপিটাল সার্জিক্যাল টিমকে নেতৃত্বে দেন।

এই অস্ত্রোপচার হয় তিন ঘন্টার বেশি সময় ধরে। অবশ্য এই অস্ত্রোপচার এর মধ্যে দিয়ে রিকভারির লম্বা পর্ব শুরু হয়। অস্ত্রোপচারের পর গৌর মণ্ডলকে আইটিইউতে ট্রান্সফার করা হয় যেখানে ভেন্টিলেশনের সাপোর্ট দেওয়া হয়েছিল। ওনাকে সেরিব্রাল ডি কঞ্জেস্টেন্ট এবং ব্যথা কমার ওষুধ দেওয়া হয়। এছাড়া তাড়াতাড়ি সেরে ওঠার জন্য অ্যান্টিবায়োটিক দেওয়া হয়। তার জ্ঞান ফিরে আসে এবং ধীরে ধীরে উন্নতি দেখা যায়। প্রথমে তাকে এইচডিইউতে তাকে নেওয়া হয় এবং পরবর্তী সময়ে সাধারণ ওয়ার্ডে ট্রান্সফার করা হয়। গৌর মন্ডলের সেরে ওঠা বেশ গতির মধ্যে হতে থাকে। উনি মণিপাল হসপিটালের বিভিন্ন বিশেষজ্ঞ ডাক্তারদের অধীনে ছিলেন, যার মধ্যে ছিলেন ডঃ সায়ন চক্রবর্তী, কনসালটেন্ট, সংক্রমক বিভাগ, ডঃ বিশরূপ মুখার্জি, কনসালটেন্ট, ইএনটি সার্জারি বিভাগ, ডঃ কমল সিনহা, কনসালটেন্ট, ফিজিক্যাল মেডিসিন বিভাগ, ডঃ কৌশিক মুখার্জি, কনসালটেন্ট, সিটিভিএস সার্জারি বিভাগ, ডঃ সুমন দাস, কনসালটেন্ট ম্যাক্সিওফেসিয়াল সার্জারি বিভাগ।

ডঃ নিরূপ দত্ত, কনসালটেন্ট নিউরোসার্জন, মণিপাল হসপিটাল, ঢাকুরিয়া, বলেন,” আমরা হতভম্ব হয়ে গিয়েছিলাম গৌর মন্ডলের আঘাত দেখে। বাঘের আক্রমণে একাধিক ফ্র্যাকচার হয়েছিল। এছাড়া ওনার মুখের একাধিক জায়গায় চোট ছিল যা বিভিন্ন জায়গার কার্যকরিতার ভয়ংকর ক্ষতি করেছিল। এর ফলে ওনার নিউরোলজিক্যাল ইম্পেয়ারমেন্ট হতে পারত। ওনার হাড়ের এবং পার্শ্ববর্তী টিস্যুর চোট কিরকম, তা বোঝার জন্য সিটি ইমেজের থ্রি ডি কন্সট্রাকশন করা হয়। এটি সার্জিক্যাল

টিমকে পরিষ্কার ছবি দেয় অস্ত্রোপচার কতটা সূক্ষ্ম ভাবে করতে হবে। আমাদের মণিপাল হসপিটালের টিম অক্লান্ত পরিশ্রম করেছে যাতে সেরা ফল পাওয়া সম্ভব হতে পারে। “

নিজের ভয়ংকর অভিজ্ঞতার কথা বলতে গিয়ে গৌর মন্ডল জানান,” আমি একটি মাছ ধরার নৌকায় ছিলাম। হঠাৎ কোথার থেকে একটি বাঘ এসে আমাকে আক্রমণ করল। এই ধাক্কায় আমি অতর্কিতে নৌকা থেকে জলে পড়ে যাই। তবে আমি একবারের জন্য লড়াই করা থেকে থামিনি, যেটা সম্ভবত বাঘটিকে ভয় পাইয়ে দিয়েছিল। যখন আমার দুই সাথী আমাকে সাহায্য করার জন্য এগিয়ে আসল এবং লড়াইতে যোগদান করল, তখন বাঘটি শেষমেশ ওই জায়গা ছেড়ে চলে গেল। আমাকে দ্রুত নিয়ে আসা হয় স্থানীয় হাসপাতালে এবং পরবর্তীকালে আনা হয় মণিপাল হসপিটাল ঢাকুরিয়াতে। আমি সত্যি ভাগ্যবান, যেভাবে জীবন ফিরে পেয়েছি। তবে আমি ভীষণ ভাবে কৃতজ্ঞ মণিপাল হসপিটালের ডাক্তার এবং নার্সদের কাছে। তাদের সাহচর্য এবং পরিষেবা আমাকে মৃত্যুর নাগাল থেকে ফিরিয়ে এনেছে।”

গত ৩০ শে আগষ্ট ২০২৪ তাকে যখন ডিসচার্জ করে দেওয়া হল, তখন সে হিমোডায়নামিকালি স্টেবল ছিল, পুরোপুরি জেগে থাকার সাথে সাথে সাড়া দিচ্ছিল সবকিছুতে। এছাড়া কোন রকম সাহায্য ছাড়াই নিজের দুই হাত, দুই পা নাড়াতে পারছিল। মন্ডল বাবু বাড়ি ফিরছেন। পরবর্তী সময়ে উনি ফলো আপের মধ্যে থাকবেন, যেখানে লক্ষ্য রাখা হবে ওনার পরিস্থিতির কতটা উন্নতি হচ্ছে, নিশ্চিত করা হবে যাতে ধীরে ধীরে স্বাভাবিক জীবন যাপনে ফিরতে পারেন।

মণিপাল হসপিটালস সম্পর্কে: দেশের অন্যতম সেরা চিকিৎসা পরিষেবা প্রদানকারী হিসেবে, বছরে মিলিয়নের বেশি মানুষকে পরিষেবা দিয়ে থাকে মণিপাল হসপিটালস। এই হসপিটালের লক্ষ্য হল সাধারণ মানুষের আয়ত্বের মধ্যে উচ্চ মানের চিকিৎসা পরিকাঠামো তৈরি করা, যেখানে মাল্টি স্পেশালিটি এবং টারসিয়ারী কেয়ার ডেলিভারি স্পেকট্রাম এবং পরবর্তীকালে হসপিটালের বাইরেও এই পরিষেবা ছড়িয়ে দেওয়া। মেডিকা সিনার্জি হসপিটাল অধিগ্রহণের পর এবং সেপ্টেম্বর ২০২৩ সালে আমরি হসপিটাল লিমিটেড অধিগ্রহণের পর বর্তমানে এই সারা ভারত ব্যাপী হসপিটালের নেটওয়ার্কের মধ্যে রয়েছে ১৯ টি শহর জুড়ে ৩৭টি হসপিটাল, যেখানে রয়েছে ১০,৫০০ বেশি বেড এবং ৫৬০০+ বেশি ডাক্তার এবং কর্মচারীর সংখ্যা ১৮,৬০০ বেশি। মণিপাল হসপিটালস সব মিলিয়ে একটি সর্বাঙ্গীন কিউরেটিভ এবং প্রিভেনটিভ কেয়ার পরিষেবা প্রদান করে থাকে রোগীদের, যারা সারা বিশ্ব থেকে আসেন। মণিপাল হসপিটালস এর রয়েছে  এনএবিএইচ (NABH) এবং এএএইচআরপিপি (AAHRPP) এর অ্যাক্রেডিসন। এছাড়া এই নেটওয়ার্কের বেশির ভাগ হসপিটালের রয়েছে এনএবিএল (NABL), ইআর (ER), ব্লাড ব্যাংক এর অ্যাক্রেডিসন। এছাড়া উন্নতমানের নার্সিং পরিষেবা দেওয়ার জন্য খুব সুখ্যাতি রয়েছে। এছাড়া মণিপাল হসপিটালস বিভিন্ন কনজিউমার সার্ভে অনুসারে ভারতের সবচেয়ে সম্মান প্রাপ্ত এবং রোগীদের দ্বারা রেকমেন্ডেড বলে পরিচিত হয়েছে।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *