সুস্বাগত বন্দ্যোপাধ্যায়
পর্ব- 7
চার্ণকের পাটনায় থাকার ইচ্ছে একদম ছিল না।অজ পাড়া গাঁ।সিন্ধিয়ায় ভূমিজ,খারিয়া,সরিয়া, মালাররা বিহারীদের
আদিম বংশধর। মোষ চড়ানো অড়র,গেউ, সর্ষের চাষ আর বিকেলে তুলসী দাসের রামচরিত পাঠ-,সিন্ধিয়ার দেহাতিদের এটাই জীবন। এই অজপাড়াগাঁয়ে রাতের কনসার্ট নেই, বলড্যান্স নেই। জঘন্য নেটিভ
জংলী জীবন।তবুও থাকতে হবে কোম্পানীর অর্ডার।
১৬৭০এর সেপ্টেম্বর মাসে হুগলিতে কোম্পানীর এজেন্ট সেম ব্রীজ সাহেব কে চিঠিতে লিখেই দিলেন ‘পাটনার এই গন্ডগ্রামে আর থাকতে চাই না’।হুগলির এজেন্টর পক্ষ থেকে চার্ণককে অনুরোধ করা হয় একটা বছর কাজ চালিয়ে যাবার জন্য।পরের বছর ঈষ্ট ইন্ডিয়া কোম্পানী পাটনা এজেন্টের পদে জব চার্ণককে মনোনীত করে এবং বেতন বাড়িয়ে লন্ডন থেকে
ইনডেন্চার সাহেবর কাছে আসে। কি আর করবে অগত্যা চাকরির টানে থেকে যেতে হল।
এদেশে এসে সাহেব ফার্সি ভাষা শিখিছিল। নায়েব -সুবেদার দের সাথে কথাবার্তা-ফরমান দস্তাবেজ পড়তে-লিখতে চার্ণকই একমাত্র পারত। সে চলে গেলে মোঘল শাসকদের সাথে কে বাতচিত করবে!চার্ণকের দেশে ফেরা আর হল না। তারওপর উটকো ঝামেলা কাঁধের চেপে বসল।
মোতিয়াকে বাঁচাতে গিয়ে সে নিজেই ফেঁসে গেল।কোথায় তাঁকে আশ্রয় দেবে?
সাত পাঁচ ভাবতে ভাবতে দুপুর গড়িয়ে বিকেল হয়ে গেল।পশ্চিম আকাশে সূর্য হেলে পড়েছে। গোধূলির আকাশটা
মেটে সিদুঁরের রঙে সেজে উঠেছে। দক্ষিণা হাওয়ায় বেশ ভালো লাগছে।তবুএখানে থাকা যাবে না।এই সময় বন্যপশুরা জল পান করতে আসে।তাদের মুখের কাছে পড়লে রক্ষা নেই।
চার্ণক ঠিক করল আজকের রাতটা তাঁর কুঠিতে
মোতিয়া থাকবে।তারপর ঘর ভাড়া করে মোতিয়ার থাকার ব্যাবস্থা করা যাবে। মোতিয়াকে ঘোড়ার পিঠে বসিয়ে সোজা কুঠিতে। ঘোড়া থেকে নামতে না নামতেই রুক্ষ মেজাজে চার্ণক
গলা চড়িয়ে হাক দেয়,বৈজুলাল জলদি আও।সে সাহেবের চাবুকের শব্দ দুর থেকে শুনতে পেয়ে আগে থেকেই দাঁড়িয়ে ছিল। ‘এ ছোকড়ি কো ঘর মে লে যাও।’বৈজুলাল থতমত খেয়ে কি করবে ভাবতে পারছে না। সাহেব কোন গলি থেকে এই মাগিকে তুলে নিয়ে
এসেছে?নোংরা মাগি,ছোট জাতেরই হবে।সে মিশ্রা
ব্রাহ্মণ। এই মাগিকে ছুঁলেই গ্রামের লোকেরা একঘরে করে দেবে।সাহেবের হুংকারে বৈজুলালের টনক নড়ে।জাতের চেয়ে সাহেবের চাবুকের মার আর ভয়ংকর। সে পাঁজাকোলা করে তাঁর ঘরের পাশে মোতিয়াকে নিয়ে রাখে।
বন মুরগির ক্যারি-রুটি ,আর স্কচের বোতল শেষ
করে চার্ণক হুকোর টান দিতে দিতে ভাবে কিভাবে
মোতিয়াকে রক্ষা করবে,সালপেটের গুদামে যাওয়া
হল না, কাশিমবাজার কুঠিতে কোম্পানীর চীপ এজেন্টর কানে যদি যায় মোতিয়ার কথা তাহলে আর রক্ষে নেই!আবার কি
রিট করবে পাটনা থেকে সরিয়ে দেবার জন্য?নেশার গভীরে কখন যে ঘুমের দেশে চলে গিয়েছে
চার্ণক জানে না ।তাঁর চাকররা এসে পালঙ্কে শুয়ে
দিয়ে যায়।
মোতিয়া কিছুই খায় নি।লোটা থেকে জল খেয়ে ছেঁড়া ময়লা কাপড়েই মাটিতে শুয়ে আছে।চোখে ঘুম নেই।
চোখের সামনে সকালের ঘটনা ভাসছে। সাহেব যদি না আসত!তাঁর জীবনের অন্ধকার রাতের গভীরতায় মিশে অসহয়তার আর্তনাদ ভেতর থেকে
বেড়িয়ে আসে।শব্দহীন এই চিৎকার কেউ শুনতে
পাবে না।