আমি আর ঝগড়া করব না

সুবল সরদার

আমার চারপাশে অগণিত মানুষের ভিড়। তবুও এ পৃথিবীতে আমার সব ফাঁকা ফাঁকা লাগে। আমি একা। বসন্ত বিদায় নিচ্ছে। শিশিরে ভিজে হেমন্তের পাতা ঝরার পালা শুরু হচ্ছে। তাই মানুষের সঙ্গে আর কোনো দিন ঝগড়া করব না। ঝগড়া করতে ভালো লাগে না। আকাশ, বাতাস, নদী, অরণ্য, ফুল কারোর সঙ্গে ঝগড়া করে না। তবে আমি কেন ঝগড়া করব। আমি তো মনে মনে মনুষ্য বর্জিত একার দেশে বাস করি। মানুষের সঙ্গে আমার কম দেখা হয়। আমি নদী, অরণ্য, পাহাড়ে বাস করি। তাই ঝগড়া করলে নদী, অরণ্য, পাহাড়ের সঙ্গে ঝগড়া করব। কৈশোরের পৃথিবী কী বিশাল মনের হয়! সদা চঞ্চল কত কর্মব্যস্ত। বসন্তের পালা বদলের পর হেমন্তের মধ্যাহ্নের আসন্ন শীতে যখন পাতা ঝরার পালা শুরু হয়, এই সুন্দর পৃথিবী ছোট হতে হতে কত ছোট হয়ে যায়! শেষ দৃশ্যে জীবননাট্যের পর্দা উঠলে দেখা যায় হেমন্তের অস্তরাগে তখন একখানা দেহ শুধু খাটের ওপর পড়ে থাকে যেন শূন্যে ভাসে। রূপ-রস-গন্ধবর্জিত একটা ক্ষুদ্র পরিসরে‌‌। এই জীবন পরিক্রমার পথ ধরে পরিত্রাণের পথ যাত্রা। আমাদের প্রপিতামহ, বাবা, মা, আত্মীয়স্বজন এই মায়াবী পথের গন্ধ শুঁকতে শুঁকতে একদিন চলে যায়। চেনা পথ তবে কত অচেনা লাগে! আমি আর কখনও ঝগড়া করব না।
এবার যদি ঝগড়া করি, খুব করে ঝগড়া করব, গলা ফুলিয়ে ঝগড়া করব, ঝগড়া করে গলা ব্যথা করব। প্রতিদিন ঝগড়া করব। সকল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত ঝগড়া করব। ঝগড়া করতে করতে দিন শুরু করে শেষ করব ঝগড়া করতে করতে।
কাল সকালে খুব করে আকাশের সঙ্গে ঝগড়া করব। কী করে এত মেঘ পায় বলো! এত বৃষ্টি! কত মায়াবী ছায়া! রাতের আকাশ আমি খুব মিস করি। নক্ষত্রখচিত আকাশের শোভা কী বাহারি! চাঁদ যেন পৃথিবীর সব ভালবাসা। চাঁদ যেন পৃথিবীর সব সৌন্দর্য। চাঁদ যেন পৃথিবীর সব হাসি। ভাবি সত্যি! আকাশকে তোমাকে আমি খুব হিংসে করি। কেন তোমার কাছে মেঘের মতো ভেসে ভেসে যেতে পারি না!
যদি ঝগড়া করি আমি ঝগড়া করর খুব করে নদীর সঙ্গে। আচ্ছা নদী, তুমি সদা চঞ্চল হয়ে কোথায় যাও! কত দেশ হয়ে, কত ঠিকানাবিহীন দেশে দেশে, পাহাড় পর্বত ঘুরে, বন জঙ্গল থেকে! কত গান তোমার কন্ঠে সদা মুখরিত বাতাসে! তোমার জিরোতে ইচ্ছে হয় না! তোমার সঙ্গে যদি যেতে পারতাম বেশ হতো। জানি তুমি আমাকে সঙ্গে নেবে না যদি পিছিয়ে পড়ি। তাই তোমার ওপর রাগ হয়। মনে হয় ঝগড়া করে রাগ মেটাই।
ঝরনার সঙ্গে দেখা হলে খুব করে ঝগড়া করতাম। তুমি কোথা থেকে আসো বলো! সদা নেচে নেচে কোথায় যাও! কেউ জানে না তোমার ঠিকানা! নূপুরের ধ্বনির মতন রিনিঝিনি সদা বাজে কানে। এত স্বচ্ছতোয়া! তৃষ্ণা মেটে প্রাণে তোমার মিঠে স্বাদে। ভেবেছিলাম একদিন তোমার উৎসের খোঁজ করব। তোমার স্বচ্ছতোয়ায় স্নান করে নবজীবন ফিরে পাব। কিন্তু সে সাধ মিটল কোথায়! তুমি কী সুন্দরী চিরকিশোরী! আমি যদি তোমার প্রেমের ব্যর্থ প্রেমিক হতাম, বিরহ শোকে তোমার নূপুরের ধ্বনি শুনে দিন কাটাতাম। তুমি আমাকে একটুও ভালোবাসো না সেটা আমি জানি। তাই তোমার ঝগড়া করতে খুব ইচ্ছা করে।
যদি পাহাড়ের মাথায় উঠি ঝগড়া করব তার সঙ্গে খুব করে। তুমি এত উঁচু আকাশের কাছাকাছি থাকো! আকাশ তোমার বন্ধু! তার সঙ্গে কী কথা বলো কানে কানে। সাবার ওপরে তুমি তারপর নীচে আমাদের পৃথিবী। তুমি কী মহান! কী বিশাল! কী বড়ো! তোমাকে কেউ হিংসা করতে পারবে না। তোমার সঙ্গে ঝগড়া করতে পারি না বলে তোমার সঙ্গে ঝগড়া করতে খুব ইচ্ছা করে।
একদিন খুব করে ঝগড়া করব অরণ্যের সঙ্গে। অরণ্যের দিনরাত্রি সব সমান। তুমি এত নির্জনতা কোথায় পাও! নির্জনতায় হারিয়ে যেতে তোমার খুব ভাল লাগে! কত পাখি গান গায় তোমার গাছে গাছে! বাসা বাঁধে তারা কত সুখে। কত সুখী তারা! কত পশুর বাস! কত ফুলের মেলা! কত সুখের সংসার তোমার! নিষ্ঠুর নির্মম কুঠারের আঘাতে আঘাতে তুমি যখন ক্ষত বিক্ষত তখনও তুমি নীরব। দাবদহে যখন তুমি কী নির্মমভাবে পুড়ে পুড়ে অঙ্গারে পরিণত হও তখনও তুমি কী নীরব! তোমার কষ্ট হয় না! আমার মতো তোমার কেন কষ্ট হয় না! তোমার কেন রাগ হয় না! তুমি এত ভাল কেন? প্রতিবাদ করতে পারো না? আমি চাই তুমি খুব করে ঝগড়া করো নইলে আমি তোমার সঙ্গে ঝগড়া করব।
কাল যদি ঝগড়া করি, খুব করে ঝগড়া করব বাতাসের সঙ্গে। কালবৈশাখী ঝড় তোমার কে হয়! তোমার কাছে আমার ঠিকানা রাখব না, যদি পালাও। তখন হারিয়ে যাবে আমার ঠিকানা। এত ঝড় কোথায় পাও! হাওয়া হয়ে কত দেশে দেশে ঘুরে বেড়াও, কী মজা! কত গল্প কত স্মৃতি তোমার ঝুলিতে ভরা! জানালা খুলে দিলে হাওয়ায় ভেসে আসে মানসীর গায়ের গন্ধ। ছাদে মেলা তার সবুজ শাড়ির মিষ্টি গন্ধ। বাগান থেকে ফুলের গন্ধ। অলির গুনগুনানীর শব্দ ভেসে আসে মিষ্টি সুরে। কত স্মৃতি তুমি বহন করে আনো! শৈশবের সেই স্মৃতির পথে হাঁটি তোমার হাত ধরে। মায়ের মুখটা মনে পড়ে, দাদার হাত ধরে বাজারে যাই। মাঠে যাই কাস্তে হাতে দাদার সঙ্গে ধান কাটতে। বন্ধুদের সঙ্গে খেলা করি, পুকুরে সাঁতার কাটি। স্কুলে যাই। কলেজে যাই। মানসীর দেখা পাই শুধু তোমার জন্যে। তুমি কী সুন্দর একটা স্মৃতি মধুর বাতাস! মাঝে মাঝে তোমার দমকা বাতাসে অবচেতন থেকে চেতন ফিরে পাই, অতীতকে দেখতে পাই। তোমার শিহরণে আমার অবচেতন অনুভূতি চেতন ফিরে পায়। আচ্ছা, তবুও তোমার সঙ্গে ঝগড়া করি কেন! তুমি কেন মানসীর সংবাদ আনতে দেরি করো? তোমার সঙ্গে কখনও ঝগড়া করব না। যদি আমার বন্ধু মানসীকে ফিরিয়ে দাও।
আমি আর কারও সঙ্গে ঝগড়া করব না আর কোনও দিন না।
তবে এবার যদি কখনও ঝগড়া করি, বৃষ্টির সঙ্গে ঝগড়া করব। তুমি কী অপূর্ব সৃষ্টি! কী মিষ্টি! কী ক্ষুদ্র! তবুও তুমি গড় সিন্ধু। কী অসীম ক্ষমতা তোমার। পুরো পৃথিবী তোমার দখলে। তিন ভাগ জল এক ভাগ স্থল। আমার বৃষ্টি আমার কান্না। কান্নায় ভিজে শ্রাবণের ধারায় আমি লুকাই। লুকিয়ে ভিজে কাঁদতে আমি ভালবাসি। কোনও একদিন বৃষ্টি ধারায় ভেসে যাব কোন সূদূর দেশে! আমি তখন কোথাও নেই। ভাবছি তোমার সঙ্গে ঝগড়া করব না ভাব করব। ভাব করতে পারি যদি তুমি নিয়ে যেও তোমাকে সিন্ধু পারের দেশ। কালো অন্ধকারের সেই দেশে আঁধারের সঙ্গে মিশে থাকব ভালোবেসে। তখন কারও সঙ্গেই আমার আর ঝগড়া হবে না। কোনও মানুষের সঙ্গে ঝগড়া হবে না। তোমাদের সঙ্গেও না। করওর সঙ্গে না।
শুধু একজনের সঙ্গে ঝগড়া করব। যদি কখনও মানসীর সঙ্গে দেখা হয় শুধু তার সঙ্গে ঝগড়া করব। তাকে শুধাই— কৈশোর ছেড়ে, ভালবাসার দেশ ছেড়ে, আমাকে ছেড়ে এত দিন কোথায় ছিলে! সেই ডায়মন্ড হারবার ফকির চাঁদ কলেজ, নদী, ঝাউবনে সবুজ ঘাসের নদীর তীর, নদীর ঢেউ, পাগল করা দমকা বাতাস তোমার মনে পড়ে! তারা তোমাকে খোঁজে। স্বপ্নে তারা ঢু্ঁ দেয়। যদি কখনও দেখা হয় তার সঙ্গে শুধু ঝগড়া করব?

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *