কলকাতা ২০২৪ :মাস্টারদা সূর্যসেনের ঘনিষ্ঠ সহযোগী বিপ্লবী অনুরূপ চন্দ্র সেন ১৯২০ সালে তৎকালীন ব্রিটিশ শাসকদের চোখে ধুলো দিয়ে কলকাতা থেকে প্রায় তিরিশ কিলোমিটার দূরবর্তী অধুনা বজবজ ২ নম্বর ব্লকের অন্তর্ভুক্ত বুরুল গ্রামে আত্মগোপন করেছিলেন।এই সময়ে তিনি বুরুল হাইস্কুলে চার বাৎসরিককাল নিজেকে শিক্ষকতার কাজে নিয়োজিত রেখে ছাত্র-ছাত্রী এবং অঞ্চলের মানুষের মনে স্বাধীনতার স্পৃহা জাগিয়ে তোলেন। পাশাপাশি জাতপাত ধর্মের বিভাজন দূর করতে মানুষ গড়ার কর্মযজ্ঞেও নিজেকে নিয়োজিত রাখেন। কিন্তু বেশিদিন এই অবস্থায় থাকা তার পক্ষে সম্ভব হয়নি। ব্রিটিশ সরকার গোপনসূত্রে খবর পেয়ে তাকে গ্রেফতার করে কারাগারে নিক্ষেপ করে। সেখানে দীর্ঘদিন রোগ-ভোগ ও বিনা চিকিৎসায় তাঁর মৃত্যু ঘটে। তাঁর এক গুণমুগ্ধ ছাত্র ও সেচমন্ত্রী বুরুল নিবাসী শ্রীযুক্ত প্রভাসচন্দ্র রায় ও সমসাময়িক এক একদল শিক্ষানুরাগী মানুষের স্বপ্ন সাধ ছিল এলাকায় উচ্চশিক্ষা প্রসারের লক্ষে একটি কলেজ প্রতিষ্ঠা করা। অগত্যা, ১৯৯১ সালের ১৬ই নভেম্বর পশ্চিমবঙ্গের তৎকালীন মুখ্যমন্ত্রী জ্যোতি বসু কর্তৃক বিপ্লবী অনুরূপ চন্দ্র সেন এর নামাঙ্কিত কলেজটির দ্বারোদঘাটনের মাধ্যমে এই এলাকায় উচ্চ শিক্ষার প্রসারের সূচনা ঘটে।কলেজের বর্তমান প্রিন্সিপাল অধ্যাপক শান্তনু কুমার সেনের কাছ থেকে জানা যায়,
দক্ষিণ ২৪ পরগনার প্রত্যন্ত এলাকার এই কলেজটি গড়ে উঠেছে ৮৭০০ বর্গমিটার এলাকা জুড়ে। সবুজের সমারোহে, গাছগাছালিতে ভরা কলেজে প্রাঙ্গণে প্রবেশ করলেই মন ভালো হতে বাধ্য। মূল প্রবেশপথের একপাশে নজরকাড়া সবুজ গালিচার মতো খেলার মাঠ পেরিয়ে যখন কলেজের প্রধান প্রশাসনিক ভবনের সামনে পৌঁছালাম, বিশেষভাবে নজরে পড়ল শহীদ অনুরূপ চন্দ্র সেনের আবক্ষ মর্মর মূর্তি। মূর্তির দুই পাশে দুটি ফটো-সেনসিটিভ সোলার ল্যাম্প (Photosensitive Solar Lamp) লাগানো যা রাত্রে মশালের মতো সর্বক্ষণ মূর্তিটিকে আলোকিত করে রাখে। বিগত ৩৩ বছরে ধাপে ধাপে কলেজ কর্তৃপক্ষের সুসংহত পরিকল্পনার মাধ্যমে বর্তমানে এই কলেজটি প্রায় দুই হাজার ছাত্রছাত্রী বিদ্যাচর্চার প্রধান ক্ষেত্রে পরিণত হয়েছে। কলেজের বর্তমান অধ্যক্ষ ডঃ শান্তনু কুমার সেন তার বর্ণনায় শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানটির সর্বাঙ্গীণ বিকাশের এক সামগ্রিক চিত্র তুলে ধরলেন।বর্তমানে কলেজটিতে কলা, বিজ্ঞান, ও বাণিজ্য বিভাগে মাল্টিডিসিপ্লিনারি কোর্সের পাশাপাশি বাংলা, ইংরেজি, ইতিহাস, রাষ্ট্রবিজ্ঞান, দর্শন ও ভূগোলে মেজর কোর্স বা অনার্স পড়ার সুযোগ রয়েছে। উল্লেখ করার মতো বিষয় হলো প্রতিটি ছাত্র-ছাত্রীর জন্য রয়েছে আবশ্যিক কম্পিউটার বেসিক কোর্সের ব্যবস্থা যা পশ্চিমবঙ্গের অন্য কোন কলেজে আছে কিনা জানা নেই। রয়েছে রয়েছে কমিউনিকেটিভ ইংলিশ সহ প্রায় আটাশটি অ্যাড-ওন (Add On) সার্টিফিকেট কোর্সের ব্যবস্থা। যার থেকে ছাত্র-ছাত্রীরা তাদের নিয়মিত কোর্সে পড়াশোনার পাশাপাশি দক্ষতা বাড়ানোর জন্য বেছে নেয় তাদের পছন্দের addon কোর্স বা সার্টিফিকেট কোর্স।কলেজে শিক্ষার পরিকাঠামো অবাক করার মত। মোট নয়টি পূর্ণাঙ্গ স্মার্ট ক্লাস রুম (Smart classroom with smart board) সহ ১২ খানা আইসিটি (ICT) ক্লাসরুমে ক্লাস হয় এখানে। রয়েছে 5G Wi-Fi ক্যাম্পাস এবং এটি ওই এলাকার একমাত্র কলেজ যেখানে 5G মোবাইল নেটওয়ার্ক প্রথম স্থাপিত হয় রিলায়েন্সের হাত ধরে ২০২৩ এ। কম্পিউটার ল্যাব, আধুনিক যন্ত্রপাতি ও সুযোগ সুবিধা যুক্ত ভূগোল এবং শরীর-শিক্ষার বিভাগীয় ল্যাব হাতে-কলমে শিক্ষাকে কার্যকরীভাবে সফল করেছে। পঠন পাঠনের পাশাপাশি শরীরচর্চা ও খেলাধুলার জন্য রয়েছে জিমনাসিয়াম, যোগাসেন্টার এবং দুটি বড় খেলার মাঠ এবং একটি ভলিবল কোর্ট।কলেজের গ্রন্থাগারটি বিশেষভাবে নজর কাড়ে, প্রায় ২২ হাজার টেক্সট ও রেফারেন্স বই সমৃদ্ধ এই গ্রন্থাগারে রয়েছে দৃষ্টিহীনদের জন্য পড়াশোনার বিশেষ ব্যবস্থা। কলেজের গ্রন্থাগার The National Institute for the Empowerment of Persons with Visual Disabilities (Divyangjan) এর সক্রিয় সদস্য হওয়ায় কলেজ ছাড়াও বাইরের দৃষ্টিহীন ছাত্র-ছাত্রীরা এই গ্রন্থাগারে পঠন-পাঠনের সুযোগ নিতে পারে। তাছাড়া আমেরিকান সেন্ট্রাল লাইব্রেরী, ব্রিটিশ কাউন্সিল লাইব্রেরী, N-LIST, NDLI সহ বিভিন্ন সংস্থার সদস্য হওয়ায় গ্রন্থাগারে শিক্ষক-শিক্ষিকা ও ছাত্র-ছাত্রীদের জন্য রয়েছে অনলাইন শিক্ষার বিশাল সম্ভার।সমাজ সেবামূলক ও জাতীয় সেবামূলক কাজে ছাত্র-ছাত্রীদের নিয়োজিত উদ্বুদ্ধ করার জন্য রয়েছে NSS এবং NCC-র মত জাতীয় সংস্থার সদস্যপদ। বর্তমানে কলেজের NSS ইউনিটের ২০০ জন এবং NCC ইউনিটে ১০০ জন ছাত্রছাত্রী এই সুযোগ-সুবিধা পায় যার মধ্যে ছাত্রীদের সংখ্যা উল্লেখযোগ্যভাবে বেশি। NSS ইউনিটের মাধ্যমে কলেজের পার্শ্ববর্তী গ্রামকে দত্তক নিয়ে সেখানে সাধ্যমত স্বাস্থ্য পরীক্ষা শিবির, বিভিন্ন ধরনের সচেতনতা শিবির এবং শিক্ষা সামগ্রী বিতরণের ব্যবস্থা করা হয়। এলাকার মানুষের মধ্যে যেমন এর ইতিবাচক প্রভাব পড়েছে তেমনি এর মাধ্যমে ছাত্র-ছাত্রীদের মধ্যে সমাজসেবার প্রতি আগ্রহ বৃদ্ধি পেয়েছে।
কলেজের আরো বেশ কয়েকটি প্রকল্প বিশেষ উল্লেখের দাবি রাখে। বৃষ্টির জল সংরক্ষণ ও তার পুনর্ব্যবহার (Rain Water Harvesting and Reuse), পূর্ণনবীকৃত শক্তি (Renewable Energy) হিসেবে সৌর শক্তির (Solar Energy) ব্যবহারে যেমন নজর দেয়া হয়েছে তেমনি শক্তি সংরক্ষণের উপায় হিসেবে টিচার রুম, অধ্যক্ষের কক্ষ, প্রতিটি টয়লেট প্রভৃতি জায়গায় মোশন, টাইমার ও ফটো সেন্সর (Motion, Timer and Photo Sensor) ব্যবহার করে বিদ্যুৎ শক্তির অপচয় রোধে ব্যবস্থা নেয়া হয়েছে। সম্পূর্ণ কলেজ ক্যাম্পাস সুচারুভাবে সবুজায়ন পরিকল্পনা বিশেষভাবে নজর কাড়ে। এনভারমেন্ট এনার্জি অডিট এর মাধ্যমে প্রতিটি গাছের নাম ও বারকোড সমন্বিত বিবরণ সংরক্ষণের ব্যবস্থা আছে।
ছাত্র-ছাত্রীদের কাজের বাজারের উপযোগী করে তোলার জন্য ক্ষেত্রেও কলেজের কর্তৃপক্ষের বিশেষ নজর আছে। “ক্যারিয়ার কউন্সেলিং সেল” এর উদ্যোগে প্রতিবছর বিভিন্ন সেমিনার ও ওয়ার্কসপের আয়োজন এর পাশাপাশি ২০২৩ এ TCS কলেজটিকে বেছে নেয় ১০০ ঘন্টা এমপ্লয়্যাবিলিটি ট্রেনিং এর জন্য। ৪৮ জন ছাত্রছাত্রী সফলভাবে ট্রেনিং শেষ করে এবং প্রায় অর্ধেকের কাছাকাছি TCS সহ অন্যান্য কোম্পানিতে কর্মে নিয়োজিত হয়। এই বছরও বাজাজ ৩৫ জন ছাত্রছাত্রীদের এই রূপ ট্রেনিং এর ব্যবস্থা করেছে।
এইভাবে অত্যন্ত গ্রামীণ এলাকার এই কলেজটি ৩৫ জন শিক্ষক – শিক্ষিকা এবং শিক্ষাকর্মীর নিরলস প্রচেষ্টায় ধীরে ধীরে এলাকার একটি উল্লেখযোগ্য উচ্চশিক্ষা কেন্দ্র হিসেবে গড়ে উঠেছে। সঙ্গে রয়েছে দক্ষ ও দূরদৃষ্টি সম্পন্ন অধ্যক্ষের সুযোগ্য নেতৃত্ব।
কলেজের ওয়েবসাইট : www.sacm.ac.in