গানগল্প

প্রদীপ্ত চৌধুরী

মানবেন্দ্র মুখোপাধ্যায়ের সবচেয়ে জনপ্রিয় গান কোনটা? তিনি নিজে মনে করতেন ‘আমি এত যে তোমায় ভালোবেসেছি’। গানটা তৈরি হয়েছিল গার্স্টিন প্লেস-এ আকাশবাণী ভবনের পাঁচ নম্বর স্টুডিওয়, এক অদ্ভুত ছমছমে নির্জনতার মধ্যে। তখন সন্ধ্যা নেমেছে সদ্য। বারান্দায় পায়চারি করছিলেন মানবেন্দ্র। পাশেই কবরখানা। চারপাশে ক্রমশ গাঢ় হচ্ছে অন্ধকার। এমন সময় হঠাৎ যেন কার গলার আওয়াজ ভেসে এল!

— “এই মানব, এখানে কী করছিস?” চমকে উঠলেন মানবেন্দ্র। প্রশ্নকর্তাকে ভালো করে দেখাও যাচ্ছে না। শুধু তাঁর চোখ দুটো দপদপ করে জ্বলছে। ভয় পেয়ে একটু জোরেই মানবেন্দ্র এবার বলে উঠলেন, “কে?” উত্তরটা দিলেন বন্ধু গীতিকার শ্যামল গুপ্ত। বললেন, “তোর খোঁজেই এলাম। একটা দুর্দান্ত গান লিখেছি। একবার শুনবি?”

বিখ্যাত গীতিকারের তখন প্রেমপর্ব চলছে বাংলার মধুকণ্ঠী গায়িকা সন্ধ্যা মুখোপাধ্যায়ের সঙ্গে। সেই প্রেমেরই উচ্ছ্বাস গানের প্রায় প্রতিটা শব্দে। গানটার কাব্যগুণে মুহূর্তে আচ্ছন্ন হলেন মানবেন্দ্র। বন্ধু শ্যামলকে টানতে টানতে নিয়ে গেলেন পাঁচ নম্বর স্টুডিওর দিকে। স্টুডিওর দরজায় সেই সময় তালা ঝোলার কথা। অথচ অদ্ভুত ব্যাপার। দরজাটা খোলা। ভিতরে বিশাল যে পিয়ানো, সেটাতেও কোনও চাবি দেওয়া নেই। মানবেন্দ্র বসে পড়লেন পিয়ানোর সামনে। সুরের আলোয় মুছে গেল অন্ধকার। তৈরি হল বাংলা আধুনিক গানে রোমান্টিকতার এক নতুন মাইলফলক ‘আমি এত যে তোমায় ভালোবেসেছি’।

‘মায়ামৃগ’ ছবিতে সুর করেছিলেন মানবেন্দ্র। সে ছবির গানও আজ ইতিহাস। মানবেন্দ্ররই গাওয়া একটা গান ছিল তাতে… ‘মেটেরিয়া মেডিকার কাব্য’। গানটায় বেশ কিছু ইংরেজি শব্দ ব্যবহার করেছিলেন গীতিকার শ্যামল গুপ্ত। ফার্মাকোলজি, ডিসেকশন, প্রেসক্রিপশন…এইরকম কিছু বিজাতীয় শব্দ। এক সন্ধ্যায় গানটায় সুর করতে বসে মানবেন্দ্র খুব রেগে গিয়েছিলেন। গুচ্ছ ইংরেজি শব্দ দেখে বিরক্ত হয়ে গান-লেখা কাগজটা দলা পাকিয়ে জানলা দিয়ে বাইরে ফেলে দিয়েছিলেন। শ্যামল তাতে হতাশ হয়ে পড়ায় কিছুক্ষণ বাদে একটা টর্চ নিয়ে দু’জনে মিলে সেই কাগজটা আবার খুঁজতে বেরোলেন। বেশ কিছুক্ষণ খোঁজাখুঁজির পর অবশেষে সেটা পাওয়া গেল একটা ড্রেনের মধ্যে। জলের তোড়ে তখনও সেটা ভেসে যায়নি। আজ প্রায় ৬০ বছর পরেও সেই গান সমান জনপ্রিয়। কালস্রোতেও তা ভেসে যায়নি।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *