গানগল্প

প্রদীপ্ত চৌধুরী

পর্ব -১

আমাদের জন্ম থেকে মৃত্যু পর্যন্ত তো শুধু গানেরই বিস্তার। যে কান্না দিয়ে জীবনের শুরু, সেই কান্নার মূলেও তো সরগমই। আবার মরাকান্নাও তো সুরে সুরেই ছড়িয়ে দেয় তার অতলান্ত বিষাদ। মধ্যপর্বে কত অন্তরা আর সঞ্চারির ছড়াছড়ি! মাঝি দাঁড় বেয়ে চলে গানের সুরে। শ্রমিক হাতুড়ির ঘা মারে গান গাইতে গাইতে। আবার অন্ধ কানাইয়ের ভিক্ষার হাতিয়ারও সেই গান। আমরা বাঙালিরা এই গানের মায়াজালেই জড়িয়ে থাকি আজীবন। আমাদের স্মরণ-বরণ-উৎসব-অনুষ্ঠান, সবেতেই শুধু গান আর গান। ফাঁসির মঞ্চেও জীবনের জয়গান গাইতে আমরা ভুলি না।

চল্লিশ পেরিয়ে আসা বাঙালি এখনও স্মৃতিমেদুর হয়ে পড়ে পুরনো বাংলা গানগুলি শুনলে। অবিস্মরণীয় সব গান এখনও তাকে বিবশ করে, বিহ্বল করে। ভেতরটা একেবারে তোলপাড় হয়ে যায় তার। এইসব গানের অনেকগুলির জন্মবৃত্তান্তের সঙ্গেই কিন্তু জড়িয়ে আছে নানা রঙের ঘটনা। এ লেখায় তেমনই কয়েকটি গান তুলে আনছি আলোচনায়।

বাংলা গানের ইতিহাসে একটা গোটা অধ্যায় দাবি করতে পারেন গীতিকার গৌরীপ্রসন্ন মজুমদার। চিকিৎসক সুরকার নচিকেতা ঘোষের সঙ্গে তাঁর ছিল নিবিড় বন্ধুত্বের সম্পর্ক। ঢোলা পাজামা আর লম্বা পাঞ্জাবি পরে প্রায় সকালেই তিনি গাড্ডায় (গান আর আড্ডা) যেতেন শ্যামবাজারে নচিবাবুর বাড়িতে। দেদার আড্ডা আর খাওয়া-দাওয়ার ফাঁকে ফাঁকে চলত নতুন নতুন গান তৈরির কাজ। একদিন এমনই এক আড্ডার মাঝে হেমন্ত মুখোপাধ্যায়ের জন্য গান লিখতে গিয়ে থমকে গেলেন গৌরীপ্রসন্ন। মাথাটা কিছুতেই যেন কাজ করছে না। নচিকেতাকে বললেন, “চল তো বাইরে যাই, কোথাও গিয়ে খেয়ে আসি।” কিন্তু পয়সা কোথায়? নচিকেতা তখন বাড়ির পুরনো পরিচারকের জমানো পয়সা চুরি করে গীতিকার বন্ধুকে নিয়ে হাজির হলেন শ্যামবাজারের বিখ্যাত গোলবাড়িতে। গোলবাড়ির পরোটা আর কষা মাংস খেতে খেতে গৌরীপ্রসন্ন ওয়েটারকে বললেন, “ভাই, একটু লেখার কাগজ হবে?” কাগজ পাওয়ামাত্র শুরু করে দিলেন লিখতে। লিখে গেলেন প্রায় একটানে। তারপর দু’জনে বাড়ি ফিরে সেই গানটা নিয়েই ব্যস্ত হয়ে পড়লেন। ঘন্টাখানেকের মধ্যেই জন্ম নিল হেমন্ত মুখোপাধ্যায়ের জীবনের অন্যতম শ্রেষ্ঠ গান ‘আমার গানের স্বরলিপি লেখা রবে’।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *