প্রদীপ্ত চৌধুরী
পর্ব – আট
একটা দিনের কথা খুব মনে পড়ে। কিন্তু ঘটনাটা মনে পড়লে খুব আক্ষেপ হয়। অফিস যাওয়ার একটু পরেই সতীনাথদা বললেন, ‘চলে যাও প্রেস ক্লাবে। উস্তাদ বিলায়েৎ খাঁ প্রেস কনফারেন্স ডেকেছেন।’ আমি বললাম, ‘ওরে বাবা আমি তো সেতার-টেতারের কিছুই বুঝি না। অন্য কাউকে পাঠালে হয় না?’ সতীনাথদা বললেন, ‘সৃজন থাকলে আর তোমায় পাঠাতাম না। তুমিই যাও। বিলায়েৎ যা বলবেন, তুমি শুধু নোট করে নেবে।’
অফিসের অদূরেই প্রেস ক্লাব। সময়ের একটু আগেই পৌঁছে গেলাম সেখানে। একেবারে নির্ধারিত সময়ে শুরু হয়ে গেল কনফারেন্স। ঘর পুরো গিজগিজ করছে লোকে। বিলায়েতের পাশে বসে আছেন তাঁর দীর্ঘদিনের সহযোগী বিখ্যাত তবলিয়া অনিন্দ্য চট্টোপাধ্যায়। সাংবাদিকরা কিছু বলার আগেই কথা শুরু করে দিলেন বিলায়েৎ নিজেই। দিনকয়েক আগেই ‘ভারতরত্ন’ পুরস্কারে ভূষিত হয়েছেন পণ্ডিত রবিশঙ্কর। সেই প্রসঙ্গ তুলে প্রচণ্ড অভিমানী হয়ে পড়লেন তিনি। ভারতীয় সঙ্গীতে রবিশঙ্কর আর ওঁর নিজের অবদান বিশ্লেষণ করে সরাসরি অভিযোগ জানিয়ে বললেন, ‘আমার বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র হয়েছে। পরিকল্পিতভাবেই বঞ্চিত করা হয়েছে আমায়।’ লক্ষ করছিলাম, তাঁর প্রগাঢ় অভিমান দ্রুত রং বদলাচ্ছিল। চোখে-মুখে স্পষ্টতই ফুটে উঠছে তীব্র হতাশা আর বিশুদ্ধ রাগ। খারাপ লাগছিল খুব। শিল্পী মানুষরা সাধারণত একটু বেশিই সংবেদনশীল হন। কিন্তু তার এমন সরাসরি খোলামেলা বহিঃপ্রকাশ দেখব আশা করিনি। খুশি হলাম শুধু এই ভেবে যে এমন একটা জমাটি কপি লেখার সুযোগ নেহাত বরাতজোরেই আজ পেয়ে গেছি।
যাই হোক, সন্ধের পর অফিসে গিয়ে সময় নিয়ে যত্ন করে কপিটা লিখলাম। কপি লিখে সন্তুষ্ট হওয়ার দিন জীবনে খুব বেশি আসে না। সেদিন কিন্তু নিজের কপি পড়ে আনন্দ আর ধরে না। ভেতরে ভেতরে উত্তেজনাও তীব্র। সতীনাথদাও একবার চোখ বুলিয়ে নিলেন দ্রুত। কলম ছোঁয়ালেন না একবারের জন্যেও।
কিন্তু পরের দিন খবরটা দেখতে পেলাম না কোথাও। অথচ বাকি সব কটা কাগজের প্রথম পাতায় ঠাঁই পেয়েছিল বিলায়েতের সেই ঐতিহাসিক প্রেস কনফারেন্স। সতীনাথদাকে জিজ্ঞেস করায় বলেছিলেন, ‘আমি ভেবেছিলাম, দুদিন পরে সিনেমা-সংস্কৃতির সাপ্তাহিক পাতায় ওটা ধরাব। সঙ্গে দিয়ে দেব দু’একজন আরও বিশেষজ্ঞর লেখা।’
লেখাটা কোনওদিন আর কোনও পাতাতেই বেরোয়নি। আক্ষেপটা থেকেই গেল।