প্রদীপ্ত চৌধুরী
পর্ব -ছয়
প্রত্যেক বছর পয়লা বৈশাখের দিন মহরতের ধুম পড়ে যেত স্টুডিওপাড়ায়। ওইদিন অন্তত পাঁচ- ছ’টা ছবির মহরত হত মহাসমারোহে। সাংবাদিকরা দল বেঁধে এক স্টুডিও থেকে আরেক স্টুডিওয় হানা দিতেন। ছবির পিআরও-রাই তাঁদের পাকড়াও করে নিয়ে যেতেন মহরতের অনুষ্ঠানে।
একবার বন্ধু স্থানীয় এক পিআরও-র অনুরোধে আমরা দুটো ট্যাক্সি করে রওনা হলাম বেহালার দিকে। কী ব্যাপার? না, সেখানে এক অখ্যাত স্টুডিওয় ততোধিক অখ্যাত ব্যানারে নতুন একটা বাংলাছবির মহরত হবে গান রেকর্ডিং দিয়ে। এই ধরনের প্রকল্পের ভবিষ্যৎ সাধারণত কী হয়, সেটা আমাদের ভালোমতোই জানা ছিল। তাই এই প্রচণ্ড গরমে বেহালা দৌড়তে প্রথমে কেউই রাজি ছিল না। কিন্তু উপরোধে ঢেঁকি তো একেকদিন গিলতেই হয়।
কিন্তু অকুস্থলে গিয়ে স্টুডিওর অবস্থা দেখে তো আমাদের আক্কেল গুড়ুম। লজঝরে, স্বল্প পরিসর, একটা জীর্ণ দোতলা বাড়ির সংকীর্ণ দুটো ঘর মিলিয়ে বানানো হয়েছে স্টুডিও। বানানোর চেষ্টা হয়েছে। কেন না, সিঁড়ি দিয়ে দোতলায় উঠতে গিয়েই ‘সাউন্ড প্রুফ’ দেওয়াল ভেদ করে দিব্য কানে ভেসে আসছিল গানবাজনার সুর। বাজনার আড়ালে চাপা পড়া নারী-কণ্ঠটা কিন্তু চমকে দেওয়ার মতো। যেমন মিষ্টি তেমন সুরেলা। আমাদের অন্য একটা ঘরে বসানো হল। হাতে ঠাণ্ডা পানীয়র বোতল ধরিয়ে আমাদের পিআরও বন্ধু আলাপ করিয়ে দিল ছবির প্রযোজক, পরিচালক এবং সুরকারের সঙ্গে। তিনজনেই মনে হল এই লাইনে প্রথম। ওদিকে দুর্বল ‘সাউন্ড প্রুফ’ দেওয়াল ভেদ করে অদেখা গায়িকার সেই সুরেলা কণ্ঠস্বর কানে যেন মধু ঢেলে চলেছে। শব্দটা ক্ষীণ হলেও খুব অস্পষ্ট নয়। আমরা তার সঙ্গে দেখা করার জন্য ক্রমশ উৎসুক হয়ে উঠেছি। তাছাড়া পাইপলাইনে তখনও আরও মহরত অপেক্ষা করে আছে।
এর কিছুক্ষণ বাদেই আমাদের অনুরোধে সেই গায়িকাটিকে সেখানে নিয়ে আসা হল। দেখলাম, নিতান্ত সাধারণ দেখতে এক কিশোরী, এখনও লজ্জার আড় ভাঙেনি যার, প্রায় অধোবদন হয়ে মাটির দিকে তাকিয়ে আছে। সাংবাদিকদের দু’একজন খাতা-কলম খুলে ওই মেয়েটিকেই ইন্টারভিউ করতে বসলেন। মিনিটখানেক পরেই প্রযোজক ভদ্রলোক এবার তাঁদের থামিয়ে মেয়েটিকে একটু বাইরে যেতে বললেন। মেয়েটি বেরিয়ে যাওয়ার পর তিনি বললেন, ‘আরে ও তো ডামি সিঙ্গার। আসল গানটা তো গাইবেন আশা ভোঁসলে। আজ শুধু ট্র্যাক রেকর্ডিং হবে।’ আশার কথা শোনার সঙ্গে সঙ্গে আমাদের সব আশাও ওখানেই শেষ হয়ে গেল। বলা বাহুল্য, সে ছবি আর হলের মুখ দেখেনি। দুঃখের ব্যাপার, ওই মেয়েটির মুখও আমরা কোনওদিন আর দেখতে পাইনি। কিন্তু তার সেই গানের রেশ এখনও যেন লেগে আছে কানে।