সেকেলে কলকাতা একালের চোখে

সুস্বাগত বন্দ্যোপাধ্যায়

                                        পর্ব-৩

নদীর জলে ভেসে উঠেছে কৃষ্ণপক্ষের আধফালি চাঁদ।শিউলি ,শেফালি, বনযুঁই ফুলের গন্ধে নদীর ছোট ছোট ডেউ মিশে যায় নিস্তব্ধ সমাধির নিঝুমতার অতলে। রাতের অন্ধকারকে জ্যোৎস্নার আলো মনে করিয়ে দেয় সময়ের খেলা।আমাবস্যার অন্ধকারে ঢেকে থাকে চাঁদ।প্রতিপদের অর্ধবৃত্ত রেখায় ফিরে আসে। এই আলো আধারি পথে আধারের আলো থাকে স্মৃতির অন্তরালে।  সুতানুটির ঘাটে বজরা ভিড়তে আর বেশী দেরি নেই। বজরার ওপরে দাঁড়িয়ে চার্ণকের সামনে  মোতিয়ার অবয়ব।নদীর ডেউ-র ছলাত ছলাত শব্দে তাঁর কানে ভেসে আসে মোতিয়ার নূপুর ধ্বনি।

 কাহাররা পালকি বাহক।সাড়ে ছয়ফুট লম্বা,আটত্রিশ ইঞ্চি বুকের ছাতি, গোঁফ ঝুরি,মিলেমিশে কালো,একহাতে পালকির অন্য হাতে লাঠি নিয়ে যখন চলে ,মনে হয় যমদূত আসছে ।মোতিয়া জাতে কাহার,  কালো হলেও চটকদার। প্রগলভতা চোখ  দুটি কার্তিক মাসে ভোরের আকাশে শুকতারার আলো। মায়াবী চাউনি, তন্বী।দুগালে টোল পড়া হাসির ছলাকলায় পুরুষ তো বধ হবেই।
বাপ খাওয়াতে না পেরে মোতিয়াকে পাটনা থেকে ১৩ কিলোমিটার দুরে সিঙ্গিয়ার রেন্ডি গল্লিতে
 বিক্রি করে দেয়। উপায় কি !মহাকবি কালিদাস বলেছেন না মেয়ে আর অর্থ হল পরের সম্পত্তি । যত পার লুটে নাও। এই লুটের বাজার বিছানা।  লাস্যরসের চপলতা ব্যান্ড ইমেজ। এই ইমেজে পুরুষ মশগুল। ঘরের লক্ষী ও চঞ্চল। কতদিন আর ঘরে থাকবে।লক্ষীর চলে গেলে জীবনটা ক্যাকটাস।
উর্মিবাঈ-এর বয়স হয়েছে।এখন আর বাবু ধরে না।পাটনাই বাবু  হীররে নাকছাবি  পড়িয়ে নথ ভেঙেছে তাঁর।সিঁথিতে মেটে সিঁদুর দিয়ে লালগঞ্জে ঘর দিয়েছে। দুঃখ একটাই, নিসন্তান। মোতিয়াকে একটু আলাদা চোখে রাখে।যখন  সে আসে দেখতে ছিল -শীতের পাতা ঝরা কৃষ্ণচূড়া।খসখসে ত্বক। শাঁসে-জলে বেড়েছে।ব্ক্ষ যুগল জলশঙ্খ।১৫ থেকে ৫০ বছরের বাবুরা ওর জন্য পাগল ।ষোল বছর বয়সেই পেটের টানে যৌন বিনোদনে মজা খুব বুঝেছে। সাথে মদ আর খিস্তি বিলাস-বাবুর মেজাজকে রাজা করে দেয়। মোতিয়া-লাগা চুনরি মে দাগ।
 
জব চার্ণকের আর ভালো লাগছে না।ইংল্যান্ড ছেড়ে ১৬৫৬- ৫৭সালে আয়ন কেন,ড্যানিয়েল শিল্ড,জন প্রিডি র সাথে ভারতে আসা,হুগলির কাশিমবাজার সেন্ট জর্জ ফোর্টের ফিফ্থ অফিসারের দায়িত্ব ,তারপর সেখান থেকে পাটনার শালফেটের ব্যবসায় কোম্পানীর এজেন্টর দায়িত্ব সামলাতে সামলাতে জীবনটা চরা পড়ে গিয়েছে।'বোতলের সুধায় গলা ভেজে, চরা ভেজে না,বুঝলে শিউচরণ শেঠ।'
 
শিউচরণের কাপড়ের ব্যাবসা। কোম্পানীর দালাল-ই করে ভালই কামাচ্ছে। কামালে কি হবে যেভাবে
মোঘল সম্রাট ঔরঙ্গজেব করের বোঝা চালাচ্ছে তাতে ব্যাবসা লাটে ওটার উপক্রম। টাকার টানাটানি চলছে। কোম্পানির এজেন্ট জব চার্ণকের কাছ থেকে সুদের বিনিময় টাকা ধার চাইতে -ই হবে। সে জানে চার্ণক সাহেবের একাকীত্বের কষ্ট। তা যদি কোন ভাবে লাঘব করা যায় তাহলে কোম্পানির সাথে কাপড়ের ব্যাবসা ফুলে ফেঁফে উঠবে।
ইংল্যান্ডে যাবার জাহাজে সালপেটের বস্তা মুটে, খালাসিদের দিয়ে ডকে তুলে দিয়ে কোম্পানির এজেন্ট চার্ণক সাহেব কুঠিতে  ফিরে  হুকোর ছিলিমে শুকটান । ক্লান্তহীন শ্রমে মগ্ন।আর একটু বাদে হুইস্কি আর ডিনার প্লেট।আবছায়া অন্ধকারে কে- শিউচরণ ?
হ্যা সাহেব ,
 চার্ণক,'এত রাতে কী প্রয়োজনে? '
শিউচরণ, সম্রাট ঔরঙ্গজেবের রাদিফা ,পাটনায় ইংরেজদের সাথে ব্যাবসা করতে গেলে  অতিরিক্ত কর  দিতে হবে।সম্রাট সাহজাহানের অসুস্থতার সময়ে তাঁর মেজোছেলে সাহ সুজার  শাসনে রাজমহল থেকে পাটনায় শান্তি ছিল। রাজ্যপাট দখলের লোভে আগ্রার যুদ্ধে সেজোভাই ঔরঙ্গজেবকে হারিয়ে বাংলাদেশ  দখলের যুদ্ধ যাত্রার সুযোগে দিল্লি দখল।দিল্লির সম্রাট ঔরঙ্গজেব আর বাংলার সুবেদার সাহ সুজা।কোম্পানীর সাথে আমার ব্যাবসায় করের উৎপাত।
সাহেব পায়ে ধরি,হাজার টাকা ধার দিন , সুদ দেবো।

চার্ণক:পা ছাড়ো। কাল সকালে দেখা কোরো। 
অনেক ভাবনা চিন্তার পর শিউচরণকে আড়াই পার্সেন্ট কমিশনে টাকা ধার দিলেন।
চার্ণক  কোম্পানীর এজেন্ট। তাঁর বছরের বেতন ২০ থেকে ৪০ পাউণ্ড হয়েছে।এই কমিশন টাকা নিজে নিলে কোম্পানীর সাথে নিমকহারামি করা হবে।সাত- পাঁচ ভেবে শেষে কোম্পানীর ফান্ডে
জমা দিলেন। শিউচরণ -চার্ণকের দোস্তি জমেছ
হুইস্কির পেগ গলায় ঢালে। বনমুরগীর রোষ্ট দিয়ে সুরারস।কখনো বা শ্যাম্পেন। মাঝেমধ্যে গুলাবি গল্লি। সত্যি চার্ণকের চামচাগিরি করে  শিউচরণের জীবন হয়ে উঠেছে শ্যাম্পেনের ফোয়ারা।

 আজ হোলি।চলো সাহেব ফাগুয়ার রঙ খেলতে।চার্ণক আগে কোনদিন রঙ খেলে নি।বিহারী পোশাকে বসন্ত কা হোলির রঙ।ছোকড়া- ছুকড়ি, মাগি-মদ্দ ,সবাই এ- ওর গালে ফাগুয়ার আবিরে লাল করছে।ঢোল বাজিয়ে ভোজপুরী গান।
রেন্ডি গল্লির পাশ দিয়ে যাবার সময় গলি থেকে ছুটে এসে আটারোর মতিয়া  সাহেবের দুগালে চার আঙুলে ফাগুয়ার রঙে লাল করে দিল। কি মোলায়েম স্পর্শ।  ফনিমনসার বুকে হলুদ কুসুম। মতিয়ার রঙচটা হলুদ শাড়ির আঁচল  সাহেবের গায়ে লেগে গেল।দুরাভিসারের নির্বাক সুখ। সাহেব  বাঁহাতের তিন আঙুলে মতিয়ার থুতনি আলতো করে ধরে দুগালে ও কপালে আবিরের ছোঁয়া লাগতেই মতিয়া অন্তরের যন্ত্রণায় নিজেকে হারিয়ে ফেলল।  ভুল গেল , সে রেন্ডি,বেশ্যা,
 পুরুষের পিয়াসার রসপাত্র। ।'আমি নারী।'
সাহেব চলে গেল কুঠীতে।ভাঙের নেশায় এপাড়ার সবাই চুড়। মতিয়া সাহেবের আবিরে মাখা সুখের আয়নায় নিজেকে দেখছে। 

বেলা যায়,আর নয় ,'চানতো করতেই হবে'।গন্ডকী নদীর জলে ডুব দিতে গিয়ে মনে পড়ে গেল উর্মিবাঈ-এর কাছে শোনা গন্ডকী বেশ্যার নদী হয়ে ওঠার গল্প।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *