নানা রঙের দিনগুলি

প্রদীপ্ত চৌধুরী

পর্ব তিন

বহু খ্যাতিমান শিল্পীর সাক্ষাৎকার নিয়েছি সাংবাদিক জীবনে। তাঁদের মুখোমুখি বসে কথা বলার সময় যে কী শিহরণ অনুভব করতাম, তা বলে বোঝাতে পারব না।সালটা যতদূর মনে পড়ছে 2001। আশা ভোঁসলে এসেছেন কলকাতায়। পিয়ারলেস হোটেলে চলছে সাংবাদিক বৈঠক। বেশ কিছু সাংবাদিকের মুখোমুখি হয়েছেন তিনি। তাঁরা নানারকমের প্রশ্ন করে চলেছেন তাঁকে।

আমিই বা এই সুযোগ ছাড়ি কেন? একটু ভেবে-চিন্তেই গুছিয়ে একটা প্রশ্ন করলাম তাঁকে। বললাম, ‘পরের জন্মে কী হতে চান, লতা না আশা?’ ঠিক দু’সেকেন্ড সময় নিলেন। তারপর বললেন, ‘দারুণ প্রশ্ন করেছেন আপনি। লতাদিদি আমার চেয়ে অনেক বেটার সিঙ্গার। আমি তাঁকে ভীষণ রেসপেক্ট করি। কিন্তু তবু পরের জন্মে আমি কিন্তু আশা ভোঁসলেই হতে চাই। তবে আরও বেটার সিঙ্গার হতে চাই, আরও বেটার মানুষ হতে চাই।’ খুব ভালো লেগেছিল উত্তরটা।

কিন্তু একটু পরে যে ঘটনাটা ঘটালেন তাতে যথেষ্ট অবাক হয়ে গিয়েছিলাম। আশাজি যখন কথা বলছিলেন, তখন তাঁর কণ্ঠস্বরটা শোনাচ্ছিল বেশ মোটা। শ্রুতিমধুর তো নয়ই, বরং বেশ কর্কশই। ভাবছিলাম, সত্তরের কাছাকাছি বয়স, এমনটা তো হতেই পারে।

প্রেস কনফারেন্স গড়িয়ে তখন শেষের দিকে। সবাই মিলে তাঁকে চেপে ধরলেন, একটা গান শোনাতে হবে। প্রথমে রাজি হচ্ছিলেন না কিছুতেই। অবশেষে নিমরাজি হয়ে চোখ বন্ধ করে কয়েক সেকেন্ডের মধ্যে গলাটা সুরে ফেললেন ভারত-কাঁপানো কিন্নরকণ্ঠী। সেই বিখ্যাত গান। ‘যেতে দাও আমায় ডেকো না।’

দু’চার লাইন গাইলেন। কিন্তু তাতেই তো একেবারে স্তব্ধ হয়ে গেলাম। একটু আগে কথা বলার সময় তাঁর যে স্বরটা শুনছিলাম, গানের সময় সেটা উধাও হয়ে গেল। তার বদলে ভেসে উঠল সেই চির পরিচিত স্বর। সেই ভেতর কাঁপিয়ে দেওয়া সুর। মনে হল, উনি তো গাইছেন না, লিপ দিচ্ছেন। আমরা রেকর্ডে শুনতে পাচ্ছি সেই আদি অকৃত্রিম আশা-কণ্ঠ। ‘যেতে দাও আমায় ডেকো না।’ এরপর মন্ত্রমুগ্ধ আমরাও তাঁকে আর ডাকিনি। শুধু নির্বাক হয়ে তাঁর চলে যাওয়াটাই দেখেছি।

তবে আশার কথা এই যে, আজও তিনি আমাদের মধ্যেই আছেন। ৮ই নভেম্বর তাঁর ৯০ তম জন্মদিন পার করে।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *