জয় ভট্টাচার্য, ক্রীড়া সাংবাদিক
তাঁরা পঞ্চ পাণ্ডব। লোকমুখে তাঁরা এই নামেই পরিচিত। অনেকেই হয়তো পঞ্চ পাণ্ডবের কথা শুনে মহাভারতের পাণ্ডবদের কথা ভাবছেন। আবার অনেকে ভাবছেন বিখ্যাত সাহিত্যিক ষষ্ঠীপদ চট্টোপাধ্যায়ের সেই কালজয়ী উপন্যাসের পাণ্ডব গোয়েন্দা ব্রিগেডের কথা। এটাই স্বাভাবিক।
আসলে তা নয়। আমি মহাভারতের পাণ্ডব কিংবা পাণ্ডব গোয়েন্দার সেই দুঁদে পঞ্চ পাণ্ডবদের কথা বলছি না। আমি যাঁদের কথা বলতে চাইছি, তাঁরা হলেন ভারতীয় ফুটবল জগতে এক একজন ধ্রুবতারা। এই ধ্রুবতারাদের তালিকায় অনেকেই আছেন। কিন্তু সেই বিশেষ পাঁচজন কিংবদন্তি ফুটবলার একত্রে পরিচিত হয়েছিলেন পঞ্চ পাণ্ডব নামে। আর তাঁদের সেই পরিচিতি যতদিন ভারতীয় ফুটবল থাকবে, ততদিন হরোপ্পা-মহেঞ্জোদরো সভ্যতার মতো তাঁরাও জ্বল জ্বল করবেন ইতিহাস বইয়ের পাতায়। এই পঞ্চপাণ্ডব হলেন আপ্পারাও, সালে, ভেঙ্কটেশ, ধনরাজ এবং আমেদ খান। একত্রে ভারতীয় ফুটবলের পঞ্চপাণ্ডব।
ভারতীয় ফুটবলের জনক নগেন্দ্র প্রসাদ সর্বাধিকারী। মূলত তাঁর হাত ধরেই ফুটবল নামক গোলাকার বস্তুটির প্রেমে পড়েন আপামর বাঙালি। যে প্রেম এখনও রয়েছে অটুট। আর থাকবেও চিরকাল তা।
এই পঞ্চপান্ডব নিয়ে জানতে হলে আমাদের তার আগের বেশ কিছুটা পিছনে ফিরে যেতে হবে। ভারতীয় ক্লাব ফুটবলে সেই ব্রিটিশ শাসনের সময় থেকেই জন্ম হয় বর্তমান তিন প্রধানের। অবশ্য তিন প্রধানই শুধু নয়, শহিদ মিনারের নীচে আরও অনেক ক্লাবেরই জন্ম হয়েছিল ব্রিটিশ আমলে। যাই হোক পরবর্তীতে ভারতের ক্লাব ফুটবলে দাপিয়ে বেড়ানো এই তিনটি ক্লাব হল মোহনবাগান, ইস্টবেঙ্গল এবং মহমেডান স্পোর্টিং ক্লাব।
কলকাতা ময়দানে পঞ্চ পাণ্ডব নামে ওই পাঁচ তরুণ ফুটবলারের আবির্ভাব ঘটে ১৯৫০ সালে। ইস্টবেঙ্গল ক্লাবের লাল-হলুদ জার্সি গায়ে। সেই সময়ের ইস্টবেঙ্গল কর্তারা এই পাঁচ ফুটবলারকে দলে খেলার জন্য নিয়ে এসেছিলেন সুদূর দক্ষিণ ভারত থেকে। তারপর তো বাকিটা ইতিহাস। ১৯৪৮ থেকে ১৯৫২ এই চার বছর ভারতীয় ফুটবলে পায়ের ছোঁয়া পড়েছিল এই পাণ্ডব ব্রাদার্সের।
যে সময় ভারতীয় ফুটবলের মক্কায় পাঁচ দক্ষিণী ফুটবলার খেলতে এসেছিলেন, সেই সময় বিশ্ব ফুটবলের সবুজ গালিচায় দাপিয়ে বেড়াচ্ছে লাতিন আমেরিকার দুই প্রতিবেশী দেশ উরুগুয়ে এবং ব্রাজিল। একদিকে এক দেশ যেমন প্রথম বিশ্ব জয়ের (সেই সময় বিশ্বকাপ ফুটবলের নাম ছিল জুলে রিমে কাপ) তা জয় করেছিল, তেমনি পেলে, গ্যারিঞ্চা, ভাবাদের দেশ ব্রাজিল তিনবার বিশ্বকাপ জয়ের স্বাদ পেয়েছিল। তেমনি পেলে, গ্যারিঞ্চা, ভাবাদের মতো ভারতীয় এই পাঁচ তরুণ। খেলা হত ২-৩-৫ ফর্মেশনে। ভারতেও সেই একই ফর্মেশনে খেলা হত। এখনকার মতো এক একটা মহাদেশের আলাদা কোনও ঘরণা ছিল না।
কলকাতা ফুটবলে এই ফর্মেশনে প্রথম খেলা শুরু করে মহমেডান স্পোর্টিং। তবে এই ছকের বাস্তব রূপ এসেছিল পঞ্চ পাণ্ডবের সময়েই। এই কথা অস্বীকার করার কোনও উপায় নেই। যাই হউক পঞ্চ পাণ্ডবদের মধ্যে ভেঙ্কটেশ খেলতেন রাইন ইনে, সালে ছিলেন লেফট ইনে, মূল স্ট্রাইকার ধনরাজের পিছন দিকে মূলত খেলাটা অপারেট করতেন আপ্পারাও এবং আমেদ খান।
সেই সময় ভারতীয় ফুটবল প্রথম দেখেছিল রাইট ইন থেকে কাট করে ভেতরে প্রবেশের কৌশল। আর অপর প্রান্তে খেলা সালের ছিল দূরন্ত গতি। আমেদ খান এবং আপ্পারাওয়ের ভূমিকা ছিল মাঝমাঠে মূল খেলাটা পরিচালনা করা। মূলত মহাভারতে অর্জুনের মতো ফুটবল নামক গোলাকার বস্তুটিকে নিয়ে আমেদ খানের ভূমিকা ছিল অনেকটা অর্জুনের মতো।
বিপক্ষ খেলোয়াড়দের নিজের পায়ের যাদুতে পরাস্ত করে আমেদ খান সেই বল সাজিয়ে দিতেন দুই উইঙ্গার ভেঙ্কটেশ ও সালের দিকে। আর সেই দুই উইঙ্গারের ভাসানো সেন্টার থেকে একের পর এক গোল গোল কলে ইস্টবেঙ্গল নামক সদ্য শতায়ু ক্লাবটির বিজ্বয়ধ্বজা এগিয়ে চলেছিল। নেপথ্যে ছিলেন ধনরাজ নামক পঞ্চ পাণ্ডবের এক পাণ্ডব। সেই সময় এই ধষরাজের খেলা দেখে তাঁকে ইংল্যান্ডে নিয়ে যেতে চেয়েছিলেন এক ইংরেজ। কিন্তু ধনরাজ দেশ ছেড়ে বিদেশের মাটিতে খেলতে রাজি হননি।
মাত্র তিনেক অর্থ্যাৎ এই পঞ্চ পাণ্ডব কলকাতা ময়দানে খেলেছেন লাল হলুদ জার্সি গায়ে। এই সময়ের মধ্যে ১৯৪৯ সালে পঞ্চ পাণ্ডবের হাত ধরে লিগ, শিল্ড ও রোভার্স ট্রফি জয় করে প্রথমবার ভারতীয় ক্লাব ফুটবলে এক নতুন মাইলফলক স্পর্শ করে ইস্টবেঙ্গল ক্লাব। এবং তারপর সবার প্রথম সালে এই জুটি ভেঙে মহমেডান ক্লাবে গেলেও বাকি চার পাণ্ডব কিন্তু রয়ে গিয়েছিলেন লাল হলুদেই। পরে অবশ্য ইস্টবেঙ্গলে ফিরেও আসেন এই ফুটবলারটি।
পঞ্চ পাণ্ডবের হাত ধরে ইস্টবেঙ্গল ক্লাব প্রথম ডুরান্ড কাপ জয়ের স্বাদ পেয়েছিল ১৯৫১ সালে। তারপর থেকেই ভারতীয় ক্লাব ফুটবলে নিজেদের পরিচয় জানান দিতে শুরু করে ওপার বাংলার উদ্বাস্তুদের জন্য তৈরি হওয়া ইস্টবেঙ্গল ক্লাব।
বর্তমানে সকলেই জানেন ভারতীয় ক্লাব দলগুলোর মধ্যে বিদেশি দলের বিপক্ষে ফলাফল এবং পারফরম্যান্সের নিরিখে সব সময়ই অন্য ভারতীয় দলগুলোর থেকে অনেক এগিয়ে মশাল বাহিনী। এঈ সাফল্যের শুরুটাও হয়েছিল এই পঞ্চ পাণ্ডবের হাত ধরেই। তা হয়তো আজ অনেকের কাছেই অজানা।
ইস্টবেঙ্গল দল প্রথম বিদেশ সফর করে ১৯৫৩ সালে। সেবার তারা গিয়েছিল ইউরোপের অন্যতম দেশ রোমানিয়ায়। সেই বছর দলে ছিলেন না ধনরাজ। যাই হউক রোমানিয়ায় আয়োজিত ইয়ুথ কংগ্রেস টুর্নামেন্টের আসরে সব রকম প্রতিবন্ধকতাকে দূর করে ইস্টবেঙ্গল প্রথম ম্যাচে মুখোমুখি হয়েছিল অস্ট্রিয়ার বিরুদ্ধে। সেই ম্যাচে তারা সবাইকে অবাক করে দিয়ে ২-০ গোলে জয় পায়। এরপর দ্বিতীয় ম্যাচে লেবাননকে ৬-১ গোলে পরাজিত করে মশাল বাহিনী। এই টুর্নামেন্টে যখন একের পর এক ম্যাচে রোমানিয়ার মাটিতে মশালের আগুণের বহ্নিশিখায় জ্বলতে শুরু করেছে, ঠিক সেই সময় টুর্নামেন্টের কঠিন প্রতিপক্ষ জার্মানির কাছে হেরে চতুর্থ স্থান অর্জন করে ইস্টবেঙ্গল ক্লাব। নেপথ্যে নায়ক সেই চার দক্ষিণী তরুণ ফুটবলার। ওই একই বছর রাশিয়া সফরেও গিয়েছিল ইস্টবেঙ্গল। সেখানেও আহমেদ, সালে, আপ্পারাওদের পায়ের জাদুতে আটকে গিয়েছিল টর্নেডো মস্কো ক্লাব। ম্যাচের ফল হয়েছিল ৩-৩।
ক্লাব ফুটবলের পাশাপাশি এই পঞ্চ পাণ্ডব ভারতীয় দলের হয়েও দূরন্ত পারফরম্যান্স করেছিলেন। ১৯৪৮ ও ১৯৫২ সালে ভারত পর পর দুবার অলিম্পিকের মতো মেগা ইভেন্টে ফুটবলে নজর কাড়া ফুটবল উপহার দিয়েছিল।
এরপর ধীরে ধীরে গঙ্গা দিয়ে প্রবাহিত স্রোতস্বিনী তরঙ্গীর মতো ক্রমশঃ দূরত্ব বাড়তে থাকে পঞ্চ পাণ্ডবদের মধ্যে। তার ফলে এই জুটিকে আর সেইভাবে দেখা যায়নি।
অল্প সময় হলেও ইস্টবেঙ্গল ক্লাবের সাপোর্টারদের হৃদয়ে মাঝে চিরকাল থেকে গিয়েছেন পঞ্চ পাণ্ডব। আজও তা বহমান ভারতীয় ক্লাব ফুটবলে। একবিংশ শতাব্দীর দোড় গোড়ায় দাঁড়িয়েও লেসলি ক্লডিয়াস স্মরণীর ক্লাবটি অহঙ্কারের আগুণে প্রজ্বলিত হয়। স্বাভাবিক এটা তো হওয়ারই কথা। পঞ্চ পাণ্ডব ছিলেন, আছেন এবং চিরকাল থাকবেন আপামর লাল হলুদ জনতার হৃদয় জুড়ে।