সুজিত চক্রবতী
পাহাড় আর জঙ্গলের সাথে পরিচয় আজন্ম আমার। পাহাড় ঘেরা উপত্যকায় পাকদণ্ডী পথে আচমকাই দাঁড়িয়ে পড়ি। সদ্য ফোটা পলাশকুঁড়ির সৌন্দর্যে মোহিত হয়ে। শুধু সবুজময় ঘেরার মাঝে কালো পিচের রাস্তাগুলো শান্ত, চুপ করে শুয়ে থাকে। পথের মাঝে চলে ট্রাক, মার্সিডিজ, হণ্ডাসিটি, সান্টো, ইণ্ডিকা… আর এক ধার দিয়ে সারি সারি সাইকেলে আদিবাসী দম্পতি গান গেয়ে পার করে কত দিনরাত। পাশেই ধার দিয়ে মাথায় কাঠের বোঝা নিয়ে লাইন করে হেঁটে চলে নিঃশব্দে আদিবাসী পুরুষ-রমণীরা। ‘দ্য রোড টু সার্কটির শুরু পিটাসাবার্গ শহরে। ১৮৬৭ সালে স্বপ্ন দেখা সওদাগর জামসেদজী টাটা ম্যাঞ্চেস্টারে Thomas Carlyle-র কথা শোনেন, The nation which gains control of iron soon acquires control of gold’ ব্যবসা যার রক্তে, তিনি এই ডাক ভোলেন কখন? সেই শুরু ভারতে লোহা ও ইস্পাত তৈরি কারখানা গড়ার স্বপ্ন। পিটসবার্গে ভূ-বিজ্ঞানী Charles Page Perin-এর কাছে বলেন বলো ভারতে কোথায় গড়ব এই স্টিল প্ল্যান্ট। আগে ১৮৮২ থেকে ১৯০২ সাল ঘুরেছেন সারা বিশ্ব। জার্মান ভূ-বিজ্ঞানী Ritter Von Schwarz- ভারতের খনি সম্বন্ধে রিপোর্ট পড়েছেন খুঁটিয়ে, লর্ড কার্জনের মাইনিং সম্পর্কিত উদারনীতির বিশদ ব্যাখ্যা আয়ত্ব করেছেন, আমেরিকায়
হ্যামিলটন-ইংল্যাণ্ডে জুলিয়েন কেনেডির সঙ্গে দীর্ঘ আলোচনা করেছেন বামিংহাম-ক্লিভল্যাণ্ডে। তারপর চান্দা জেলার লৌহ-আকরের লাইসেন্স নেন প্রথম।
১৯০৩ সালে ওঁর সুযোগ্য পুত্র দোরাবজি টাটা নাগপুরে তৎকালীন প্রদেশ শাসনের প্রধান স্যার বেঞ্জামিন রবার্টসনের সঙ্গে দেখা করতে সচিবালয়ের উল্টোদিকের দেওয়ালে একটি জিওলজিক্যাল মানচিত্রে দ্রুগ (Drug) ক্ষেত্রের হদিশ পান। চান্দা থেকে ১৪০ মাইল দূরে। স্থানটি সম্বলপুর জেলার অন্তর্গত ছিল তখন। ১৯০৪ সাল নাগাদ জিওলজিক্যাল সার্ভের অফিসার প্রথমনাথ বসু জে এন টাটাকে চিঠি লিখে জানান ময়ূরভঞ্জ জেলার বিপুল লৌহ আকরের কথা।
এই জায়গাটির স্থির করে ১৯০৮ সালে ৩৫৮৪ একর জমি নিয়ে তৈরি হয় টাটা স্টিলের ভিত্তি স্থাপন। সাকচি, নুনডিহ
সুসিডিহ, জুগসলাই – এই চারটি গ্রাম নিয়ে তৈরি হয় প্রথম স্টিল কোম্পানি – খরচ হয় সেই সময় ৪৬,৬৩২ টাকা।
১৯১৯ সালে সাকচির নাম হয় ‘জামশেদপুর’ – জামশেদজি টাটার নামে, কালিমাটি হয় টাটানগর। এই নামকরণ করেছিলেন।তৎকালীন ভাইসরয় Lord Cheimsford- এক শীতের সকালে শহর ও কারখানা পরিদর্শনে এসে মুগ্ধ হয়ে গেলেন আধুনিকভারতের রূপকার জে এন টাটা, জে আর ডি টাটাদের স্বপ্নের নগরী দেখে। চওড়া রাস্তা, দুধারে লম্বা ছায়া ঘেরা গাছের সারি।পরিপাটি শহরে ঢুকলেই আত্মার শান্তি। শহর ছাড়ালেই আদিবাসী গ্রাম, সবুজ বন ও নানা রঙের বর্ণালীর সাথে ছোট্ট কুঁড়েঘরগুলো মানানসই রঙে রাঙানো। তকতকে নিকোনো পাওয়া উঠোন। আদিম প্রকৃতির সাথে মিশে আছে অনেক জনজাতিও তাদের উপজাতি ‘আদিবাসীরা’।
বড় উৎসব – ‘টুসু পরব । পাগল করা মাদলের আওয়াজ, নদীর ধারে দেখা যাবে হাত ধরাধরি করে একদল আদিবাসী
নেচে চলেছে অবিরাম। নক্ষত্র, পৃথিবী কথা বলে যেন এখানে। সব কিছু বদলালেও রয়ে গেছে ‘আদিবাসী’ নামটি। কদম গাছের জঙ্গল হয়েছে কংক্রীটের জঙ্গলে ‘কদমা’। শহরের দুটিকে দুটি নদী — সুবর্ণরেখা আর ‘খরকাই’। সুবর্ণরেখার বালির চরে খুঁজলে নাকি সোনা মেলে। ‘খরকাই’ – খরক গাছের জঙ্গল দিয়ে বয়ে যায়। সুবর্ণরেখার ধারে নাম তাই ‘সোনারি’।
(2)(2)
পুরানো বেলগাছ ঘিরে ছোট্ট বস্তি ‘ডিহি’ সেখানে হয়েছে ‘বেলডি’। বেলগাছের শিকড়ের ওপর তৈরি কালীপুজোর খান। বেলড়ি কালীবাড়ির নামেই জোড়হাতে প্রণাম। ডিহি দিয়ে অনেক নাম – বারিডি’, ‘ধাতকিডি’, ‘পরমুডি’। একটি রাজপ্রাসাদ বাড়ি যার বারোটি দরজা। সেই থেকে ওই স্থানটি নাম “বারোদোয়ারী’। টেলকো, টিনপ্লেট, কেবল টাউন,এগ্রিগো এসব নাম কোম্পানিগুলোর নামে।
‘গোলমুড়ি’ হল গোল একটা মোড়। ওই শ্যামবাজারের পাঁচমাথা মোড়ের মতো। সবচেয়ে মজার নাম ‘মানগ্রো’। আগে জায়গাটির নাম ছিল উলুডিহি’। আদিবাসীরা ‘আমকে “উল’ বলে। ছিল বিশাল আমবাগান। ব্রিটিশরা উলুদিহি উচ্চারণকরতে না পারায় বলত ম্যাঙ্গো এরিয়া। সেই থেকেই নাম ‘মানগো’। খারাং নামে গাছ হয় এখানে, আদিবাসী লোকশিল্পে খারাং গাছের অনেক ব্যবহার। খারাং গাছের বন ছিল টেলকো কলোনির এক স্থানে, তাই জায়গার নাম থারাঙ্গাঝাড়’।মাইশোরের, বৃন্দাবন গার্ডেনের আদলে তৈরি জুবিলি পার্ক। ধাপে ধাপে রং-বেরং ফুল আর ঘাসের সবুজ গালিচা, মাঝখানে টলটলে জলের ধারা সাথে নানান ফোয়ারা দিয়ে লাইট অ্যাও সাউন্ডের ব্যবস্থা। ‘ড্যান্সিং ফাউন্টেন’ পার্কের অনন্য সেরা। জুবিলি পার্কের মধ্যে লেকের ধার ঘেঁসে ছোট্ট চিড়িয়াখানা। পার্কের অন্যদিকে নিক্কো পার্ক, টাটা স্টিলের যৌথ সৌজন্যে প্রমোদ উদ্যান। অ্যামিউজমেন্ট পার্ক।শহর ছাড়িয়ে ১২ কিমি দূরে ভিমনা লেক। বড় বাঁধ শহরে পানীয় জল সরবরাহের ব্যবস্থা। লেককে ঘিরে রয়েছে পলমা পাহাড়ের শ্রেণী। লোকের লাগোয়া টাটা স্টিলের গেস্ট হাউস। রয়েছে চাণ্ডিল বাঁধ। মন মাতবেই ভারি সুন্দর প্রকৃতির জলছবি টানে জামশেদপুর শহর ছাড়িয়ে ৪০ কিমি দূরে কাটাসনি ও চন্দ্র পাহাড়শ্রেণীর হাত ধরাধরি করে শিমুল, পলাশ, শাল, পিয়াল, করছ, কুর্চি, চামেলির, চম্পার গাছ ঘেরা দলমা পাহাড়। প্রকৃতির অকৃপণ হাতে সাজানো এই স্থানে সদ্য ফোটা পলাশকুড়ির লাল সমারোহ, বনানী সবুজের আভায় নীল আকাশের ছায়ায় এক অপার্থিব সৌন্দর্য্য। ঘন জঙ্গল পথে হারাবার নেই ভয়, পুরুলিয়ার অযোধ্যা পাহাড় থেকে মাঝেই নেমে আসে হাতির পাল, উড়ে আসে চেনা অচেনা অসংখ্য পাখি। পায়ের আওয়াজে ছুটে পালায় সজারু, খরগোস, হরিণের দল। মায়াবী জঙ্গলে ছুটে বেড়ায় কাঠবেড়ালি আর গাছের মগডালে অসংখ্য চিন্তামগ্ন বাদরের দল জঙ্গলে বিপদের সম্ভাবনা হঠাৎ জংলী হাতির দল ও বুনো ভাল্লুকের মুখোমুখি দেখা হলে। পাহাড়ে থাকার জন্য রিজার্ভ ফরেস্ট ও বনবাংলো, রয়েছে টাটা স্টিলের গেস্ট হাউস। জঙ্গল বড়ই রহস্যময় গাছ আর গাছ। কোথাও পাঁচিলের মতো পথ আটকায় সে, কাছে গেলেই রাস্তা করে দেয় যাবার জন্য এতই ভদ্র। জঙ্গল ডাকে আয় কাছে আয়, গিয়েও কিন্তু ছোঁওয়া হয় না।হো ভাষায় ‘কিরিবুরু’ শব্দের অর্থ ‘পোকাদের জঙ্গল। মেঘাতিরুক্ত শব্দের অর্থ জমাট বাদা মেঘের মতো ঘন জঙ্গল। দুই শহরের অবস্থান সারান্ডার জঙ্গল ঘেঁষে। কিরিবুরু থেকে একদিকে সারাণ্ডা আর অন্য দিকে শিমলিপালের জঙ্গল- বনমাতালদের আদর্শ পর্যটনস্থল এই স্থান। ৫ কিমি দূরের খনি এলাকায় বেড়ানোর সুন্দর অভিজ্ঞতা। সারা বছরই নাতিশীতোষ্ণ আবহাওয়া লাল জঙ্গলে কোয়েনা নদীর দেখা মেলে এখানেই। হো ভাষায় সারাণ্ডা শব্দের অর্থ সাতশো পাহাড়ের দেশ”। আকাশ পরিষ্কার থাকলে কিরিবুরুর গেস্ট হাউসের লাগোয়া ভিউ পয়েন্ট থেকে এই সাতশো চূড়া দেখা সম্ভব। অনন্য অভিজ্ঞতা। বনের মাছে বয়ে চলা ছোট্ট লাল ছিপছিপে নদীর ধার ঘেঁষে দাঁড়িয়ে আছে শনের নুড়ি দাঁত ফোকলা বুড়ো- ব্যাস। কিরিবুরু থেকে ঘন্টা চারেকের মধ্যে শাল, পিয়াল, মহুয়ায় ঘেরা ঘন জঙ্গলে ঘুরে আসা যায় সারাণ্ডায়। আবার শিমলিপালের জঙ্গলের চরিত্র হল শাল সেগুন গাছের ঘেরা এই অরণ্যে বাস করে ‘ওঁরাও’ আর ‘মুণ্ডা’ আদিবাসীরা।জঙ্গলের ঘনত্ব কম বলে ছোট্ট গ্রাম, বড় পাতা দিয়ে ছাওয়া ঘরের ছাদ, মাটির মেঝের কুঁড়ে ঘর, বাইরে দেওয়ালে নানান
( 3 )
ছবির আলপনা দিয়ে ঘর সাজানো।
হাতি আসে রাত দুপুরে। বাংলোর ঘর নিরাপদ, চারদিকে আট ফুট চওড়া করে গর্ত কাটা। সন্ধ্যে হলেই কাঠের পাটাতন তুলে ফেলে বাংলোর চৌকিদার। রাতের রুটির আটা মাখতে মানতে হরে রাম, হরে কৃষ্ণ’ গাইতেই একবার বলে ওঠে “আউলি রে’ – কে এলো- কে এলো উই যে মহারাজ কালো পাথরের মত হাতির দল দাঁড়িয়ে আমাদের নিরীক্ষন করে বোধ করি সন্তুষ্ট হয়েই ফিরে যায়।
শেষের কথা পাথুরে প্রাকৃতিক পরিবেশ, নীলচে সবুজ পাহাড়, সহজ সরল আদিবাসী, মিষ্টি জল, ঠাণ্ডা বাতাস, আকাশ, দুর্লভ গাছের সমাবেশে প্রকৃতির গুলের আলপনায়, পাহাড়ের রহস্যময় হাতছানিতে বারবার মনে হয় জীবন তারি সুন্দর। বাঁচার তাগিদে যেতে হয় প্রকৃতির শিকড় খুঁতে। মুক্ত নিঃশাস নিতে। তবু প্রকৃতি ধরা দেয় না কিছুতেই ছুঁতে পারি না। সেই অসীমকে। কি যেন পাওয়া হয়না আজও তাই যেতে হবে আবার প্রকৃতির রাজ্যে বারবার।